সমুদ্র: নি‘আমতের অফুরান ভাণ্ডার

0
4504

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আল্লাহ তা‘আলা এ মহাবিশ্বের মহাস্রষ্টা। তিনি বিশ্বচরাচরেরসব সৃষ্টি করেছেন মানুষের প্রয়োজন পূরণের নিমিত্তে।জাগতিক জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করার জন্য। মানুষ তাঁর সব নি‘আমত ভোগ করবে আর একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে। পার্থিব নি‘আমত কাজে লাগিয়ে পরকালের অনন্ত জীবনের সুখ সন্ধান করবে। এসব সৃষ্টির মধ্যে অন্যতম শীর্ষটি হলো সাগর। সাগর আল্লাহর এমন এক বৃহৎ সৃষ্টি যা মানুষের জন্য অফুরন্ত কল্যাণের ভাণ্ডার। মহান স্রষ্টার সৃষ্টির অন্যতম বিস্ময় এ সাগর। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষের নিরন্তর কৌতূহল জাগিয়ে রেখেছে সাগর। চলছে সাগর নিয়ে মানুষের বিরামহীন গবেষণা ও অনুসন্ধান।

সাগর কী?

সাগরহলোলবণাক্তপানির এক অতি বৃহৎ জলাশয়।শব্দটিএকাধিকঅর্থে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ‘সাগর’ বলতে বোঝায় মহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত একটি বৃহৎ লবণাক্ত জলাশয়। কখনো কখনো মহাসাগর বোঝাতেই এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়।আবার বিরাটাকার লবণাক্ত জলেরহ্রদ বোঝাতেও ‘সাগর’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন, কাস্পিয়ান সাগর।[1]

সাগর নিয়ে গবেষণা

সাগরসৈকতে জোয়ার ভাটায় যা চোখে পড়ে তাতে জ্ঞানীদের মনে অনেক ভাবনার উদ্রেক হয়। ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে যখন লবণাক্ত পানির গতি সামনে বাড়ে তখন মানুষের মনের আতংক বেড়ে যায়। সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষ ক্ষণে ধনী আবার ক্ষণে গরীব হতে পারে। মৃত্যুর ভয়ে যেমন আমরা ভীত তেমনি এ সাগরের জোয়ার মানুষকে যেন সব কেড়ে নেয়ার ভয় দেখায়। ভাটায় যখন পানি শুকিয়ে যায় তখন মানুষের দারিদ্র্যও বার্ধক্যের চিত্র ভেসে ওঠে। আকাশের চাঁদের অমাবস্যার পূর্ণিমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাগরে আসে জোয়ার-ভাটা। জেলেরা সাগরের জোয়ারে ধরে তাজা ইলিশ মাছ।চিংড়ির পোনা শিকার করে একদল মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করে। আসলে সাগর হলো বৈচিত্র্য ও বিস্ময়েরঅফুরন্ত উৎস। সাগর নিয়ে মানুষ যত জানছে, যত গবেষণা করছে, নিত্য-নতুন চমকপ্রদ সব তথ্য আবিষ্কৃত হচ্ছে। আল্লাহর মানুষের যে অফুরান কল্যাণের ভাণ্ডার সুপ্ত রেখেছেন সাগরে, গ্যাসসহ বহুবিধ খনিজ সম্পদ মজুদ রেখেছেন সাগরবুকে, তা গবেষণা ও আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষ তথা মানবতা উপকৃত হবে। তাই কল্যাণের ধর্ম ইসলামে সাগর নিয়ে চিন্তা-গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে।

যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তুমি কি দেখ না যে, ভূপৃষ্ঠে যা আছে এবং সমুদ্রে চলমান নৌকা তৎসমুদয়কে আল্লাহ নিজ আদেশে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন এবং তিনি আকাশ স্থির রাখেন, যাতে তার আদেশ ব্যতীত ভূপৃষ্ঠে পতিত না হয়। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি করুণাশীল, দয়াবান।”[সূরা আল-হজ, আয়াত: ৬৫]

বিশ্বাসী চিন্তানায়ক ও ধর্মতাত্ত্বিকরা সব সময়ই বলেনআল্লাহর পরিচয় জানতে সাগর ভ্রমণে অশেষ উপকারিতার কথা। মহান স্রষ্টা আল্লাহরঅতুলনীয় সৃষ্টিকুশলতার বিন্দুমাত্র মানুষ উপলব্ধি করতে পারে সমুদ্রের বুকে গিয়ে। আমরা তো দয়ালু ও দাতা আল্লাহকে চেনার মতো চিনতে কসুর করি, আল্লাহর অসীমতা উপলব্ধি করে তাঁর নির্দেশানুযায়ী জীবন পরিচালনায় ত্রুটি করি। এক্ষেত্রে সুবিস্তৃত আকাশ, সুউচ্চ পর্বত ও সুবিশাল সাগর প্রত্যক্ষলব্ধ জ্ঞানই পারে মানুষকে মহান আল্লাহর কুদরতের বাস্তব উপলব্ধি এনে দিতে। সাগরের বুকে ঘুরতে গিয়ে দিগন্তহীন অথৈ জলরাশির বিশাল তরঙ্গমালায় কেউ যখন মৃত্যুর খুব কাছে নিজেকে আবিষ্কার করে, তখনই সত্যিকার উপলব্ধি করে আল্লাহর অসীমতার অর্থ কী আর সৃষ্টির ক্ষুদ্রতা ও সীমাবদ্ধতার বাস্তবতা কী। এজন্যই আল্লাহর নির্দেশ, “বলুন, তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখ, কীভাবে তিনি সৃষ্টিকর্ম শুরু করেছেন। অতঃপর আল্লাহ পুনর্বার সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু করতে সক্ষম।”[সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ২০]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, “নিশ্চয়ই আসমান ও যমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে এবং নদীতে নৌকাগুলোর চলাচলে মানুষের জন্য কল্যাণ রয়েছে। আর আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি অবতীর্ণ করেছেন, তা দ্বারা মৃত জমিনকে সজীব করে তুলেছেন এবং তাতে ছড়িয়ে দিয়েছেনসবরকম জীব-জন্তু।আর আবহাওয়া পরিবর্তনে এবং মেঘমালার যা তারই হুকুমের অধীনে আসমান ও জমিনের মাঝে বিচরণ করে, নিশ্চয়ই সেসব বিষয়ের মাঝে নিদর্শন রয়েছে বুদ্ধিমান সম্প্রদায়ের জন্য।”[সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৪]

সাগরে প্রাণবৈচিত্র্য

আল্লাহর সৃষ্টি অপার রহস্যের আধার এই সাগর। সাগরের সব জায়গায় বিচরণ করার সামর্থ্য মানুষের হয়নি এখনও। ইচ্ছে করলেই মানুষ যখন তখন পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থান মাউন্ট এভারেস্টে উঠছে;কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও সাগরের সর্বনিম্ন স্থানে মানুষ পৌঁছাতে পারছেনা। সাগরের সবচেয়ে গভীরতম স্থানমারিয়ানা ট্রেঞ্চের ‘চ্যালেঞ্জার ডিপ’।গভীরতা ১০৯৯৪ মিটার (৩৬০৭০ ফুট)। হিমালয় পর্বতকে (২৯০২৮ ফুট) অনায়াসে লুকিয়ে রাখা যাবে এখানে। আর সাগরে ব্যপ্তি ও প্রসারতার পরিমাণ এখনো অপরিমেয়। সুবিশাল গভীর সমুদ্রে কত জাতের, কত বর্ণের, কত আকারের কত রকম প্রাণী যে বিদ্যমান তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন।

আমাদের বঙ্গোপসাগর কোনো সাগর নয়, মহাসাগর তো নয়ই। সামান্য এ বঙ্গোপসাগরেই কত প্রাণবৈচিত্র্য বিদ্যমান।বাংলাদেশের সেন্ট মার্টিন্সের আশপাশের সমুদ্রে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় ১৯৯৭-৯৮ সালে একটি জরিপ করে। জরিপে ৫৮ প্রজাতির জীবিত এবং ২১ প্রজাতির মৃত প্রবাল, ১০১ প্রজাতির ঝিনুক এবং শামুক পাওয়া যায়।সেন্ট মার্টিন্স দ্বীপে প্রচুর শামুক এবং ঝিনুক পাওয়া যায়। শামুক এবং ঝিনুক প্রধানত জলজ প্রাণী। এদের বেশির ভাগই সামুদ্রিক তবে কিছু স্বাদু পানিতে এবং কিছু স্থলেও পাওয়া যায়। এরা খুব আস্তে চলাফেরা করে। চলার সময় হামাগুড়ি দিয়ে চলে, আবার গর্তে লুকায়, কখনও সাঁতার কাটে। তাদের পা এ তিন কাজের উপযোগী করেই তৈরি। পরিবেশ রক্ষায় ঝিনুকেরও অবদান আছে। জীব বৈচিত্র্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ঝিনুক নিয়ে গঠিত। সামুদ্রিক খাদ্যচক্রকে সচল রাখতে ঝিনুক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরা মৃত জৈব বস্তু খেয়ে জলজ পরিবেশের স্বচ্ছতা বাড়ায়। শামুক এবং ঝিনুক সামুদ্রিক কচ্ছপ ও বিভিন্ন প্রকার মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাগরের মণিমুক্তা ও প্রবালকে আল্লাহর নি‘আমত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে সূরা রাহমানেও।

আল্লাহ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন, “তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরায়, যা তারা অতিক্রম করে না।অতয়েব, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? উভয় সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয় মণিমুক্তা ও প্রবাল। অতয়েব, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?” [সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১৯-২৫]

সাগরের মাছ

সাগরের আয়তন ও গভীরতার যেমন সীমা নেই। সাগরের বৈচিত্র্যময় প্রাণী সংখ্যার যেমন ইয়ত্তা নেই। তেমনি সাগরে কত জাতের কত বর্ণের জলজ প্রাণী ও মাছ যে বিচরণশীল তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। বাংলাদেশে ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির (মোহনাজলসহ) এবং ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও ১২-এর অধিক প্রজাতির চাষকৃত বিদেশী মাছ চাষের জলাশয়ে এবং ৭০-এর অধিক জাতের বিদেশী বাহারী মাছ এ্যাকুয়ারিয়ামে পাওয়া যায়।মৎস্য অধিদপ্তরের (২০০৯)তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে মাছের মোট উৎপাদন ২৫ লক্ষ ৬৩ হাজার ২৯৬ মেট্রিক টন। যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় (আহরিত) থেকে আসে ১০,৬০,১৮১ মেট্রিক টন, অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় (চাষকৃত) থেকে আসে ১০,০৫,৫৪২ মেট্রিক টন এবং সমুদ্র থেকে আসে ৪,৯৭,৫৭৩ মেট্রিক টন।

সাগরের মাছগুলোর মধ্যে রয়েছে লাক্ষা, কই কোরাল, দাতিনা কোরাল, রেড স্লাপার, বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ যেমন,ভেটকি, সুরমা মাছ, কাটল ফিশ, দেশি স্কুইড, রুপচাঁদা, ম্যাকারে, শ্রিম্প, টুনা, স্যামন, ম্যাকরেল, সারডিন, স্কুইড, লবস্টার, কোরাল, টুনা কড ইত্যাদি। এসব মাছ আমিষের প্রধান উৎস। এ ছাড়া সামুদ্রিক মাছে প্রচুর ফ্যাটি এসিড আছে। এই ফ্যাটি এসিড মস্তিষ্ক, চোখ ও স্নায়ুতন্ত্র গঠনে ভূমিকা রাখে।

সামুদ্রিক মাছের উপকারিতা

সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বলে শেষ করা যাবে না। মাছ মানুষের হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্ককে কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। সে জন্য চিকিৎসকেরা দীর্ঘ দিন ধরেই তাদের রোগীদের গোশতের পরিবর্তে অধিক মাছ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। সাধারণত এশিয়ার মানুষের খাদ্য তালিকায় গোশতের পরিমাণ কম থাকে। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মানুষের আয় বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান নগরায়নের কারণে বর্তমানে এশিয়ার মানুষের খাদ্য তালিকায় পশুজাত খাদ্যের পরিমাণ আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। কিন্তু চিকিৎসক ও গবেষকেরা দীর্ঘ দিন ধরেই বলে আসছেন, গোশতের চেয়ে সামুদ্রিক মাছ খাওয়ার উপকারিতা অনেক বেশি। কাজেই সামুদ্রিক মাছ বেশি পরিমাণে খেলে তা আমাদের শরীরের প্রধান দুই অঙ্গ হৃদযন্ত্র ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে। বস্তুত সামুদ্রিক মাছ মানুষের স্বাস্থ্যরক্ষায় এক বিস্ময়কর উপাদান। এ কারণেই চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিষয়ক গবেষকেরা মাছ অধিক পছন্দ করেন, ভালোবাসেন।রোগীদেরও অধিক মাছ খাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

চিকিৎসক ও চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, মাছের মধ্যে থাকা উপাদানগুলো মানুষের হৃদযন্ত্র কার্যকর ও সুরক্ষিত রাখার জন্য কাজ করে। হৃদযন্ত্র অচল ও অকার্যকর হয়ে যাওয়ার যে ঝুঁকি প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয় যেসব কারণে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে মাছের উপাদানগুলো। হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথের গবেষক ড. দারিউস মোজাফফারিয়ান বলেন, কেউ যদি নিয়মিত মাঝারি মাছ খান তাহলে তার হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়। সারা বিশ্বে পরিচালিত ৩০টি বড় ধরনের গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, যারা প্রতি সপ্তাহে অন্তত একবার বা দুইবার মাছ খান তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি গড়ে ৩৬ শতাংশ কমে যায় বলে ড. মোজাফফারিয়ান জানান।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রকে সক্রিয় ও কার্যক্ষম রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর এ মূল্যবান উপাদানের শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক উৎস হচ্ছে মাছের তেল। ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রের রিদম বা ছন্দকে দ্রুততর করে, ধমনীতে চর্বি জমার মাত্রাকে কমিয়ে দেয়, ধমনীতে পুরনো প্রদাহকে ঠাণ্ডা রাখতে সহায়তা করে ও রক্তচাপকে স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সামুদ্রিক মাছ কেবল আপনার হৃদযন্ত্রের জন্যই উপকারী নয়, এটা আপনার মস্তিষ্ককেও সুরক্ষা দিয়ে থাকে। যারা সামুদ্রিক মাছ বেশি খান তাদের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেকাংশে কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এ কমে যাওয়ার হার প্রায় ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া বিভিন্ন গবেষণা থেকে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের স্বাভাবিক ও দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় সহায়তা করে থাকে।

২০০৭ সালে প্রায় ১২ হাজার গর্ভবতী নারীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে, যেসব নারী তাদের গর্ভকালীন সপ্তাহে অন্তত ৩৪০ গ্রাম সামুদ্রিক খাবার খেয়েছেন তাদের সন্তানের বুদ্ধি যেসব নারী অন্য ধরনের খাবার খেয়েছেন তাদের সন্তানের বুদ্ধির চেয়ে ছয় গুণ বেশি। বয়স্কদের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। সম্প্রতি একটি সুইডিশ গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব যুবক সপ্তাহে একাধিকবার সামুদ্রিক মাছ খান তাদের বুদ্ধি যারা সচরাচর সামুদ্রিক খাবার খান না তাদের চেয়ে ১১ গুণ বেশি। এ ছাড়া যারা মাছ বেশি খান তাদের শেষ বয়সে ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেকাংশে কমে যায়।

গবেষণায় আরো দেখা গেছে, যারা নিয়মিত সামুদ্রিক খাবার খান (সরাসরি খাদ্য হিসেবে কিংবা পরিপূরক হিসেবে) তাদের শরীর সুস্থ থাকার পাশাপাশি বিপদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব দূরীভূত হয়। এর কারণ, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড মস্তিষ্কের দু’টি প্রধান রাসায়নিক উপাদান সেরোটোনিন ও ডুপামাইনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ দু’টি উপাদানের মাত্রা বা পরিমাণ কম থাকলেই মানসিক বিষাদগ্রস্ততা বা মনমরা ভাব সৃষ্টি হয়।[2]

সংক্ষেপে সামুদ্রিক মাছের কয়েকটি অনন্য উপকারিতা:

১. সামুদ্রিক মাছের আমিষ সহজে পরিপাকযোগ্য। এ ছাড়া দেহের বৃদ্ধি ও ক্ষয়রোধে সাহায্য করে।
২. ভিটামিন বি-এর উৎকৃষ্ট উৎস। বিশেষ করে স্যামন মাছে প্রচুর ভিটামিন বি-১২ রয়েছে।
৩. জিংক ও আয়োডিন আছে। জিংক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং আয়োডিন গলগণ্ড রোগ প্রতিরোধ করে।
৪. এ ছাড়া এসব মাছে প্রচুর সিলেনিয়াম রয়েছে, যা দেহে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে।
৫. স্যামন, ম্যাকরেল মাছ থেকে ভিটামিন-এ ও ডি পাওয়া যায়।
৬. সামুদ্রিক মাছের অমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী। এই ফ্যাটি এসিড হৃদরোগ প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে।
৭. এ ধরনের মাছ রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
৮. এই মাছের আমিষ ও তেল দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে।
৯. ডায়াবেটিস রোগীরা খাদ্য তালিকায় সামুদ্রিক মাছ রাখতে পারেন।

আল-কুরআনে সামুদ্রিক মাছ প্রসঙ্গ

পবিত্র কুরআনেও সামুদ্রিক মাছের কথা উল্লেখ করা হয়েছে একাধিক প্রসঙ্গে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তিনিই কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন সমুদ্রকে, যাতে তা থেকে তোমরা তাজা মাংস খেতে পার এবং তা থেকে বের করতে পার পরিধেয় অলঙ্কার। তুমি তাতে জলযান সমূহকে পানি চিরে চলতে দেখবে এবং যাতে তোমরা আল্লাহর কৃপা অন্বেষণ কর এবং যাতে তার অনুগ্রহ স্বীকার কর।” [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১৪]

অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,  “দু’টি সমুদ্র সমান হয় না-একটি মিঠা ও তৃষ্ণানিবারক এবং অপরটি লোনা। ঊভয়টি থেকেই তোমরা তাজা গোশত (মৎস) আহার কর এবং পরিধানে ব্যবহার্য গয়নাগাটি আহরণ কর। তুমি তাতে তার বুক চিরে জাহাজ চলতে দেখ, যাতে তোমরা তার অনুগ্রহ অন্বেষণ কর এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।” [সূরা আল-ফাতির, আয়াত: ১২]

আয়াতদ্বয়ে সাগরের মাছকে আল্লাহ তাজা গোশত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাজা গোশতের উপকারিতার শেষ নেই। তাজা গোশত মূলত পূর্বোক্ত সামুদ্রিক মাছের বহুবিধ উপকারিতারই ইঙ্গিত করছে। সামুদ্রিক বড় বড় মাছের হাড় দিয়ে বিভিন্ন অলংকার ও আসবাব বানানো হয়। আল্লাহ তা‘আলা সেদিকেও ইঙ্গিত করেছেন আয়াতদ্বয়ে। আর সামুদ্রিক বিভিন্ন শৈবাল ও শামুকে মুক্তো পাওয়া যায়, যা মূল্যবান অলংকারাদিতে শোভা বৃদ্ধি করে। তাছাড়া মানুষের উপকারার্থেই আল্লাহ সাগর ও এর উদরস্থ যাবতীয় সামগ্রী প্রস্তুত করেছেন। তাই তিনি এর শিকার ও তার গোশত ভক্ষণ বৈধ আখ্যা দিয়েছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও সুমুদ্রের খাদ্য হালাল করা হয়েছে তোমাদের উপকারার্থে এবং তোমাদের এহরামকারীদের জন্যে হারাম করা হয়েছে স্থল শিকার যতক্ষণ এহরাম অবস্থায় থাক। আল্লাহকে ভয় কর, যার কাছে তোমরা একত্রিত হবে।” [সূরা আল-মায়িদা, আয়াত: ৯৬]

মানবেতিহাসের সূচনা থেকেই সমুদ্রতীরের মানুষ তার জীবিকার সন্ধান সাগর ভ্রমণ করেছে। সাগরের পানির পবিত্রতা, এর প্রাণী শিকার ও মাছের গোশত আহারের বৈধতা ঘোষিত হয়েছে তাই মহাজ্ঞানী রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র যবানেও।আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলো, সে বললো, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা সমুদ্র বিহার করি। আমাদের সঙ্গে যৎসামান্য পানি থাকে। তা দিয়ে যদি আমরা অযু করি, তাহলে পিপাসার্ত হয়ে যাব। আমরা কি তাহলে সাগর থেকে (এর পানি দিয়ে) অযু করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এর (সাগরের) পানি পবিত্র এবং এর মৃত হালাল।”[3]

সাগরে কুরআনের বিস্ময়

আধুনিক বিজ্ঞানের যুগে বিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে আবিষ্কার করেছেন, দুই সমুদ্রের পানি পরস্পর সম্মিলিত হয় না। যেমন রোম সাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের পানি একটি অপরটির সঙ্গে একীভুত হতে পারে না। সেখানে রয়েছে বিস্ময়কর এক অদৃশ্য অন্তরায়। অথচ যে যুগে এ ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর কোনো যন্ত্রসামগ্রী ছিল না, ১৪ শ বছর আগে এমন যুগেই কুরআন বলে দিয়েছে: “তিনি পাশাপাশি দুই দরিয়া প্রবাহিত করেছেন। উভয়ের মাঝখানে রয়েছে এক অন্তরায়, যা তারা অতিক্রম করে না।অতয়েব, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে? উভয় সমুদ্র থেকে উৎপন্ন হয় মণিমুক্তা ও প্রবাল। অতয়েব, তোমরা তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন অবদানকে অস্বীকার করবে?” [সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১৯-২৫]

দুই সমুদ্র বলতে মিঠা ও লোনা সমুদ্র বুঝানো হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা পৃথিবীতে উভয় প্রকার দরিয়া সৃষ্টি করেছেন। কোনো কোনো স্থানে উভয় দরিয়া একত্রে মিলিত হয়ে যায়, যার নজির পৃথিবীর বিভিন্ন ভূখণ্ডে পরিদৃষ্ট হয়। কিন্তু যে স্থানে মিঠা ও লোনা উভয় প্রকার দরিয়া পাশাপাশি প্রবাহিত হয় সেখানে বেশ দূর পর্যন্ত উভয়ের পানি আলাদা ও স্বতন্ত্র থাকে। একদিকে থাকে মিঠা পানি, অপরদিকে লোনা পানি। কোথাও কোথাও এ মিঠাও লোনা পানি উপরে নীচেও প্রবাহিত হয়। পানি তরল ও সূক্ষ্মপদার্থ হওয়া সত্ত্বেও পরস্পরে মিশ্রিত হয় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “বল তো কে পৃথিবীকে বাসপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদীপ্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থির রাখার জন্য পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন? অতএব, আল্লাহর সঙ্গে  অন্য কোনো উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।” [সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬১]

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে: “তিনি সমান্তরাল দুই সমুদ্র প্রবাহিত করেছেন একটি মিষ্টি, তৃষ্ণা নিবারক ও একটি লোনা, বিস্বাদ। আরউভয়ের মাঝে রেখে দেন একটি অন্তরায়, একটি দুর্ভেদ্য আড়াল।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৫৩]

জ্যাক ভি. কোস্টা নামের এক ফরাসি বিজ্ঞানী সমুদ্রের ভেতরস্থ পানি গবেষণা বিষয়ে প্রসিদ্ধ।তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রোম সাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগর রাসায়নিক দিক থেকে একটি অন্যটির চেয়ে ভিন্ন রকম। তিনি এ বাস্তব সত্যটি অনুধাবন করার জন্য জিব্রাল্টার দুই সমুদ্রের মিলন কেন্দ্রের কাছাকাছি সমুদ্রের তলদেশে গবেষণা চালান, সেখান থেকে তথ্য পান যে জিব্রাল্টার উত্তর তীর (মারুকেশ) আর দক্ষিণ তীর (স্পেন) থেকে আশাতীতভাবে একটি মিষ্টি পানির ঝর্ণা উথলে ওঠে। এ বড় ঝর্ণাটি উভয় সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ৪৫ সূক্ষ্ম কোণে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয়ে চিরুনির দাঁতের আকৃতি ধারণ করে বাঁধের ন্যায় কাজ করে। এ ক্রিয়াকলাপের ফলে রোম সাগর এবং আটলান্টিক মহাসাগর একটি আরেকটির সঙ্গে মিশতে পারে না। দু’টি সমুদ্রের মিলনস্থলে যে পৃথকীকরণ বা পর্দা রয়েছে তা খালি চোখে বুঝার উপায় নেই। কেননা বাহ্যত সব সাগর একই রূপের মনে হয়।

শুধু তিনি নন;বরং অনেক মেরিন বিজ্ঞানীই এই রহস্য ভেদ করতে ব্যর্থ হন।১৯৪২ সালে শতাধিক মেরিন স্টেশন বসিয়ে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়, কোন জিনিস দুই সাগরের মিলন কেন্দ্রে বাঁধা সৃষ্টি করে আছে? তারা সেখানে আলো পরীক্ষা করেন, বাতাস পরীক্ষা করেন এবং মাটি পরীক্ষা করে এর মধ্যে কোনো বাধা বা পর্দা সৃষ্টি করার কারণ খুঁজে পান নি। এখানে পানির একটি হালকা, একটি ঘন রং পরিলক্ষিত হয়। যা খালি চোখে প্রত্যক্ষ করা সম্ভব নয়। এমনকি বিজ্ঞানীরা আরো গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধির জন্য এবং আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের দূরে থেকে অনুধাবনের পদ্ধতির মাধ্যমে বা এর মাধ্যমে ছবি ধারণ করেন। ভূমধ্য সাগরের পানি গাঢ় নীল এবং আটলান্টিক সাগরের পানি হালকা নীল, আর জিবরাল্টার সেল যা পাহাড়াকৃতির এবং তার রং হল খয়েরি।

ঘনত্ব-উষ্ণতা এবং লবণাক্ততার দিক থেকে ভূমধ্য সাগরের পানি আটলান্টিকের তুলনায় অনেক বেশি।আরো মজার ব্যাপার হলো, ভূমধ্য সাগরের পানি জিব্রাল্টার সেল বা সাগর তলের উঁচু ভূমির উপর দিয়ে আটলান্টিক সাগরের মধ্যে শতাধিক কিলোমিটার প্রবেশ করেছে এবং তা ১০০০ হাজার মিটার গভীরে পৌঁছার পরেও তার উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের ও রঙ্গের কোনো পরিবর্তন সাধিত হয়নি। যদিও এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে প্রচণ্ড ঢেউ, প্রবল খরস্রোত এবং উত্তাল তরঙ্গ তথাপিও পরস্পর মিশ্রিত হয় না এবং একে অন্যকে অতিক্রম করতে পারে না। যেহেতু উভয়ের মাঝে রয়েছে একটি পর্দা। যেমন বলা হয়েছে পবিত্র কুরআনে প্রাগুক্ত আয়াতে। সাগরের এ বিস্ময়কর সৃষ্টিরহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে অনেক গবেষক কুরআনের প্রাগুক্ত আয়াতে এর অলৌকিকতার সন্ধান পেয়েছেন। তাদের কেউ কেউ এ সূত্রে সত্য ইসলামও গ্রহণ করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ফ্রান্সের সমুদ্রবিজ্ঞানী ড. কোস্টাও ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়।[4]

কেন এ অদৃশ্য পর্দা?

মিষ্টি পানি হলো সুপেয় নদীর পানি। এ পানি মানুষের তৃষ্টা নিবারণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। নদীর মিষ্টি পানি না থাকলে সভ্যতা মরে যেত। আর লোনা পানি হলো সাগরের অতল জলরাশি। নদীর পানির মিষ্টতার মতো সাগরের পানির লবণাক্ততাও বিশাল অতি প্রয়োজনীয়। সাগরের পানি মিঠা হলে বাতাস দূষিত হয়ে যেত। জলে-স্থলে সব প্রাণী মরে যেত। সাগরের পানি লবণাক্ত হওয়ায় বাতাস সর্বদা আর্দ্র থাকে এবং এতে মারা যাওয়া প্রাণীর দেহ পচে না। সাগরের মরদেহ পচে গেলে বাতাস দূষিত হত এবং এর প্রাণবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ত।

সাগর নিয়ে কিছু তথ্য

পৃথিবীর বারিমণ্ডল ৪ ভাগে বিভক্ত : সাগর, মহাসাগর, নদী ও হ্রদ। পৃথিবীতে ৫টি মহাসাগর রয়েছে।যথা :
১. প্রশান্ত মহাসাগর,
২. আটলান্টিক মহাসাগর,
৩. ভারত মহাসাগর,
৪. উত্তর মহাসাগর এবং
৫. দক্ষিণ মহাসাগর।এসব ছাড়াও অনেক সাগর আছে।

বিশ্বের সব সাগরের পানিতে গড়ে ৩.৫% খনিজদ্রব্য আছে। অর্থাৎ প্রতি ১০০০ গ্রাম পানিতে ৩৫ গ্রাম লবণ জাতীয় উপাদান থাকে। অন্যান্য উপাদানগুলো হলো- সোডিয়াম-ক্লোরাইড ৭৭.৫৫%, ম্যাগনেশিয়াম-ক্লোরাইড ১০.৮৭ %, ম্যাগনেশিয়াম-সালফেট ৪.৭৩%, ক্যালসিয়াম-সালফেট ৩.৬%, পটাশিয়াম-সালফেট ২.৪৬%, ক্যালসিয়াম-কার্বনেট ০.৩৪%, ম্যাগনেশিয়াম-ব্রোমাইট ০.২৫%।যাকে সহজ বাংলায় বলা হয় খাবার লবণ এবং এটা পানিতে দ্রবণীয় থাকে।

ব্রাজিলের বিশাল নদী আমাজানের মোহনা থেকে ২০০ মাইল বা ৩২০ কি.মি. পর্যন্ত সমুদ্রের পানি লোনা নয় বরং মিষ্টি। ফিলিপাইনের উপকূলেও মিষ্টি পানি দেখা যায়। আবার সাগরের পানির নিচের দিকে যতই যাওয়া যায় ততই পানি লোনা। তাছাড়া সমুদ্রের পানিতে মোট ৪৫ প্রকার ধাতব লবণ মিশ্রিত থাকে। আরো আছে ৬৫ প্রকার মৌলিক ও যৌগিক পর্দাথের মিশ্রণ।[5]

বাংলাদেশের সমুদ্র জয়

৭ জুলাই ২০১৪ সোমবার নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিসি আদালতের রায়ে বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ ২৫ হাজার ৬০২ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশ পেয়েছে। বাকি ছয় হাজার ১৩৫ বর্গকিলোমিটার পেয়েছে ভারত। ইতিপূর্বে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির ফলে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর অধিকার নিশ্চিত হয়েছে।এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সুসংবাদ।

সমুদ্রের নি‘আমত কাজে লাগানো দরকার

এখন বাংলাদেশের কর্তব্য হবেতেল-গ্যাসসহ বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে যেসব নি‘আমত ও সম্পদ রয়েছে, তা সংরক্ষণ ও সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের দিকে মনোযোগী হওয়া।দুঃখজনক হলো, দুই দফায় বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে বৃহৎ নতুন সমুদ্রসীমা যোগ হলেও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সমুদ্রসম্পদকে যেভাবে কাজে লাগানোর কথা সেভাবে কাজে লাগানো হয়নি।এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ সীমিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার করে অনেক দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করলেও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য নগণ্য।

নতুন সমুদ্রসীমা ও সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণে ২০১৪ সালে সরকারের সফলতা-ব্যর্থতা সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স অনুষদের ডিন এবং দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, সমুদ্রে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়াতেই সরকার বহুলাংশে সন্তুষ্ট থেকেছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে সমুদ্রসম্পদকে যেভাবে কাজে লাগানো প্রয়োজন সেভাবে কাজে লাগানো হয়নি। সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের কাছে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়, প্রশিক্ষণের জন্য সেসব দেশে প্রতিনিধি প্রেরণ, তাদের কাছে সমুদ্রসম্পদ অর্জন করার অভিজ্ঞতা লাভ করা, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে কীভাবে তারা সম্পদ কাজে লাগিয়েছেন- এ বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপকভাবে সরকারের কাজ করার কথা থাকলেও সেভাবে নজর দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, আমাদের স্থলসীমায় কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে সেটি আমাদের জানা। এসব কূপ থেকে আমরা ১৪ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস পাব। ব্যবহারের দিক দিয়ে আগামী ১০ বছরের মধ্যে এসব সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে। সমুদ্র এলাকাতে সরকার ২৪টি গ্যাস ব্লক চিহ্নিত করেছে।

মাকসুদ কামাল মনে করেন, এতদিন সমুদ্রের বিশাল সম্পদের দিকে আমাদের নজর ছিল না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সমুদ্রের অপার সম্পদকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে ব্যাপকভাবে নজর দেওয়া উচিত। দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তুলতে সত্যিকার অর্থে কোনো পরিকল্পনা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি। তাদের সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে সরকার নজর দেয়নি। যতদিন সরকার এটি নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ না করবে, ততদিন চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত হবে না। সমুদ্রসীমায় আমাদের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয়েছে বটে, কিন্তু সার্বভৌমত্বের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক যে অর্জন হওয়ার কথা সেটি আমরা পাব না। রাজনৈতিকভাবে সরকার লাভবান হয়েছে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দেশ লাভবান হয়নি। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশগুলো সমুদ্রসম্পদ ব্যবহার করেই অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। আমাদের সমুদ্রেও অপার সম্ভাবনা রয়েছে।[6]

ভূ-কেন্দ্রিক উন্নয়নকার্যক্রমের পাশাপাশি ব্লু ইকোনমি আমাদের সামনে উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। সেজন্য সমুদ্র ও সমুদ্রসম্পদের অপার সম্ভাবনাকে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাজে লাগিয়ে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। সমুদ্রের জলরাশি এবং তলদেশে বিদ্যমান জানা-অজানা জৈব ও খনিজসম্পদের ভাণ্ডার উত্তোলনে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করতে শিল্পোন্নত দেশগুলোর সহায়তা নিতে হবে।

বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, যে দেশ সমুদ্রকে যত বেশি ব্যবহার করতে পেরেছে, সে দেশ তার অর্থনীতিকে তত এগিয়ে নিতে পেরেছে। সামুদ্রিক সম্পদের প্রাপ্যতা, উত্তোলন এবং ব্যবহার সম্পর্কে আমাদের পর্যাপ্ত জনবলের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণ এবং বঙ্গোপসাগরের তলদেশে বিদ্যমান খনিজ সম্পদের উত্তোলনেও আমাদের প্রযুক্তির অভাব রয়েছে।

সাধারণভাবে অর্থশাস্ত্রে ‘ব্লু ইকোনমি’ বলতে পণ্যভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সিস্টেম-ভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরকে বোঝানো হলেও এখানে ব্লু ইকোনমি বলতে সমুদ্রসম্পদের অর্থনীতি বুঝানো হচ্ছে। সমুদ্রসম্পদ এবং এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিঃসন্দেহে যেকোনো দেশের অর্থনীতির গতি পাল্টে দিতে পারে। স্থলবেষ্টিত দেশের অনেক সম্পদ বা সম্ভাবনা থাকলেও সমুদ্র না থাকায় তাদের সম্ভাবনাকে নানাভাবে সীমিত ও পরনির্ভর করে ফেলে। দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল, ভুটানসহ এ রকম আরো অনেক উদাহরণ রয়েছে এ ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ এ দিক থেকে বেশ সৌভাগ্যবান। এ দেশের দক্ষিণ প্রান্তের বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি দেশের জন্য বিপুল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এ সম্ভাবনা শুধু সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যের অবারিত সুযোগের জন্য নয়, একই সঙ্গে  সমুদ্র এলাকা থেকে মৎস্য, জ্বালানি ও অন্যান্য সম্পদ আহরণের বিপুল সম্ভাবনার কারণেও।[7]

আমাদের যা করণীয়

সমুদ্রের এমনসব অফুরন্ত নি‘আমতের দাবী হলো, নি‘আমতদাতাকে নিয়ে চিন্তা করা। তিনি কীভাবে এত সাগর-মহাসাগর মানুষের পদানত করেছেন, তাতে এত নি‘আমতসম্ভার সন্নিবেশিত করেছেন, তা নিয়ে ভাবনা-গবেষণা করা। বহুবিধ ঝুঁকি ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাগরতলের নি‘আমতরাজি মানবকল্যাণে আবিষ্কার করা। মানুষের আরও কর্তব্য হবে, একমাত্র আল্লাহর একত্ববাদ স্বীকার করা এবং তাঁরই ইবাদত করা। পাশাপাশি প্রাণহীন মূর্তি ও প্রতিমাসহ আল্লাহ ছাড়া সব কিছুর প্রভুত্ব অস্বীকার করা। আল্লাহ তা‘আলা এ কথাই বলেছেন নিচের আয়াতে: “বল তো কে পৃথিবীকে বাসপযোগী করেছেন এবং তার মাঝে মাঝে নদ-নদীপ্রবাহিত করেছেন এবং তাকে স্থির রাখার জন্য পর্বত স্থাপন করেছেন এবং দুই সমুদ্রের মাঝখানে অন্তরায় রেখেছেন? অতএব, আল্লাহর সঙ্গে  অন্য কোনো উপাস্য আছে কি? বরং তাদের অধিকাংশই জানে না।”[সূরা আন-নামল, আয়াত: ৬১] সমাপ্ত

[1] বাংলা উইকিপিডিয়া।
[2] দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশন থেকে প্রকাশিত মাসিক অন্য দিগন্ত ম্যাগাজিন থেকে।
[3] তিরমিযী, হাদীস নং ৬৯; আবু দাউদ, হাদীস নং ৮৩।
[4] সূত্র : ইন্টরনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণামূলক লেখা।
[5] ইউকিপিডিয়া।
[6] বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪।
[7] নয়া দিগন্ত, ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪।


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন