রামাদান : ঈমান-বৃদ্ধির মৌসুম

0
581

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

বস্তুত আমল অনুসারে ঈমান বাড়ে ও কমে। আল্লাহর আনুগত্য করলে ঈমান বাড়ে আর অবাধ্যতা করলে কমে। সালাত আদায় করলে বাড়ে, ফিতনা-ফাসাদে জড়ালে কমে। সঠিক পথে চললে বাড়ে, ভুল পথে চললে কমে। আল্লাহ তাআলা বলেন—

আর যারা সুপথপ্রাপ্ত হয়েছে, তিনি তাদের সুপথে চলার প্রেরণা বাড়িয়ে দেন এবং তাদের তাকওয়া দান করেন।[1]

অন্যত্র বলেছেন— “যেন তাদের ঈমানের সাথে ঈমান আরও বৃদ্ধি পায়।[2]

রামাদান মাসে বান্দা তার রবের খুব নিকটবর্তী হওয়ায় তার ঈমান বৃদ্ধি পায়, বিশ্বাস প্রগাঢ় হয় এবং তাওহীদের আলােয় হৃদয় উদ্ভাসিত হয়। একারণেই সিয়াম অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইবাদাত। বান্দাকে স্রষ্টার নিকটবর্তী করার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এছাড়াও রামাদান বান্দা এবং জাহান্নামের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। অনুগত মুমিন ও অবাধ্য পাপীর মাঝে পার্থক্য করে।

রামাদান মাসে ইবাদাতের নিমিত্তে রাত্রিজাগরণ মহান আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, ভালােবাসা ও আগ্রহ সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। কারণ, এতে হৃদয়ের নিফাক ও কপটতা বিদূরিত হয় এবং ঈমানের বৃক্ষ সিঞ্চিত ও ফুলে-ফলে সুশােভিত হয়।

সুতরাং, আসুন, আমরা এমন কতগুলি আমল সম্পর্কে জেনে নিই, যেগুলাে ঈমান বৃদ্ধি করে এবং বিশ্বাসে দৃঢ়তা বাড়ায়—

এক. বিনয়, একাগ্রতা ও খুশু-খুযুর সাথে জামাআতের সাথে সালাত আদায় করা। আল্লাহ তাআলা বলেন—

নির্ধারিত সময়ে সালাত আদায় করা মুমিনদের জন্য অবশ্য-কর্তব্য।[3]

জামাআতে সালাত আদায় করলে অন্তর থেকে নিফাক দূর হয়ে যায়, অন্তরে আল্লাহর ভয় সঞ্চারিত হয় এবং অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকা সহজ হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন—

নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীল ও মন্দ-কর্ম হতে বিরত রাখে। আর আল্লাহর যিকিরই তাে সর্বশ্রেষ্ঠ। তােমরা যা করাে, আল্লাহ তা জানেন।[4]

দুই. গভীর মনােযােগের সাথে কুরআন তিলাওয়াত করা। কুরআনের প্রতিটি শব্দ, বাক্য ও আয়াত নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা, কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা এবং

সেই শিক্ষা অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা। মহান আল্লাহ বলেন—

এটা এক কল্যাণময় কিতাব, এটা আমি অবতীর্ণ করেছি—যেন লােকেরা এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং বােধসম্পন্ন লােকেরা উপদেশ গ্রহণ করে।[5]

তিন. হৃদয়, জিহ্বা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা আল্লাহর যিকির করা। তাসবীহা[6], তাকবীর[7], তাহমীদ[8] ও তাহলীল[9] পাঠে জিহ্বা সতেজ রাখা। মহান আল্লাহ বলেন —

তােমরা আমাকে স্মরণ করাে, আমি তােমাদের স্মরণ করব। তােমরা আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করাে। কৃতঘ্ন হয়াে না।[10]

অতএব, রামাদানে আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ করতে হবে। রাতের শেষ প্রহরে তার কাছে দুআ-মুনাজাত করতে হবে এবং বেশি বেশি ক্ষমা-ভিক্ষা চাইতে হবে।

চার. দ্বীনী ইলম অর্থাৎ ধর্মীয় বিষয়ে গভীর জ্ঞান অর্জন করা। মহান আল্লাহ বলেন—

আর বলুন, হে আমার রব, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।[11]

উল্লেখ্য যে, জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য শুধু প্রার্থনাই যথেষ্ট নয়; বরং সাধ্য অনুযায়ী চেষ্টাও করতে হবে। প্রয়ােজনে জ্ঞানীদের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ, কুরআনে কারীমে ঘােষিত হয়েছে—

তােমরা যদি না জানাে, তাহলে জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা করাে।[12]

এ ছাড়াও সুযােগ পেলেই জ্ঞানীদের মজলিসে উপস্থিত হওয়া। কারণ, জ্ঞানীদের মজলিসে গমনকারী ব্যক্তি সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে—

তারা এমন সম্প্রদায়—যাদের সাথী-সঙ্গীরাও কখনাে দুর্ভোগ পােহায় না।[13]

অধিকিন্তু জ্ঞানার্জন ঈমানের পূর্বশর্ত ও ঈমানবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। কেননা, কুরআনে কারীমে ঘােষিত হয়েছে—

হে নবী, আপনি জেনে নিন যে, আল্লাহ ছাড়া সত্য কোনাে ইলাহ নেই এবং আপনার পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুণ।[14]

উল্লেখ্য যে, এই আয়াতে আল্লাহ সৎকাজের পূর্বে ‘জ্ঞান অর্জনের কথা বলেছেন।

পাঁচ. দান-সাদাকা ও যাকাত-ফিতরার মাধ্যমেও ঈমান বৃদ্ধি পায়। রামাদান : বদান্যতার উর্বর ক্ষেত্র’ শিরােনামে এ ব্যাপারে আমরা সমৃদ্ধ আলােচনা করেছি।

বিস্তারিত জানার জন্য সেখানে দেখা যেতে পারে।

ছয়. সৃষ্টিজগৎ এবং চারপাশে ছড়াননা আল্লাহর নিদর্শন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা। আল্লাহ তাআলা বলেন—

আর তারা আসমান-জমিনের সৃষ্টি (রহস্য) নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে। (একসময় তারা বলে ওঠে) হে আমাদের প্রতিপালক, এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আমরা আপনার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। আপনি আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুণ।[15]

রামাদান গবেষকদের মস্তিষ্ক পরিষ্কার করে। চিন্তাশীলদের চিন্তা শানিত করে। উপদেশ গ্রহণকারীদের অন্তর আলােকিত করে। এভাবে মন ও মস্তিষ্ক মহান আল্লাহর সৃষ্টি-নৈপুণ্য নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার উপযুক্ত হয়ে ওঠে।

উল্লেখ্য যে, ঈমান-বৃদ্ধির যেমন একাধিক কারণ রয়েছে, তেমনই ঈমান হ্রাস পাওয়ার, দুর্বল হওয়ার এমনকি একেবারে নষ্ট হয়ে যাওয়ারও বেশ কিছু কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি কারণ হলাে—

এক. আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ থেকে বিমুখ হয়ে মানব-মস্তিষ্কপ্রসূত নীতি ও বিধান অনুসরণ করা। যখন কোনাে বান্দা এমনটি করে তখন সে মূলত ভালাের পরিবর্তে মন্দকে গ্রহণ করে। ফলে সে দুনিয়া ও আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হতভাগ্য শয়তানের অনুচর বলে বিবেচিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন—

ওরাই হলাে শয়তানের দল। আর জেনে রাখাে, শয়তানের দলই ক্ষতিগ্রস্ত।[16]

দুই. অসার খেল-তামাশা, হারাম বিনােদন এবং বাতিলপথী ও প্রবৃত্তিপূজারীদের সঙ্গা-গ্রহণ ঈমান হ্রাস পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। মহান আল্লাহ বলেন—

হে নবী, তুমি তার অনুসরণ কোরাে না, যার অন্তরকে আমার স্মরণ থেকে অমনোেযােগী করে দিয়েছি, যে তার প্রবৃত্তির অনুসরণ করে চলে ও যার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে।[17]

তিন. অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাপকাজে ব্যবহার করলেও ঈমান কমে যায়। কারণ, পাপকাজ করার সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে কালাে একটি দাগ পড়ে। মানুষ যখন বারবার পাপকাজ করতে থাকে তখন তার হৃদয় কলুষে ছেয়ে যায়। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের গুনাহের বিবরণ নিম্নরূপ

চোখ হারাম বস্তুর দিকে দৃষ্টিপাত করে। কান গান-বাদ্য শ্রবণ করে। অন্তর কাম-বাসনার জগতে বিচরণ করে। হাত অন্যায় কাজে সাহায্য করে। লজ্জাস্থান অশ্লীলতা ও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। পেট হারাম ভক্ষণ করে।

সুতরাং, প্রত্যেক সিয়াম পালনকারীর অবশ্যকর্তব্য হলাে, রামাদানে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি খতিয়ে দেখা।বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও লঘুতা পরখ করা এবং লাভ-লােকসানের একটি খতিয়ান তৈরি করা।

হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ঈমান বাড়িয়ে দাও। ভালাে ও কল্যাণকর কাজের তাওফীক দাও।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ৯৭ – ১০২


[1] সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত :১৭
[2] সূরা ফাতহ, আয়াত : ০৪
[3] সূরা নিসা, আয়াত : ১০৩
[4] সূরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৫
[5] সূরা সােয়দ, আয়াত : ২৯
[6] সুবহানাল্লাহ বলা।
[7] আল্লাহু আকবার বলা।
[8] আলহামদু লিল্লাহ বলা।
[9] লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল।
[10] সূরা বাকারা, আয়াত : ১৫২
[11] সূরা ত-হা, আয়াত : ১১৪
[12] সূরা নাহল, আয়াত : ৪৩
[13] সহীহ বুখারী : ৬৪০৮
[14] সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত : ১৯
[15] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৯১
[16] সূরা মুজাদালাহ, আয়াত :১৯
[17] সূরা কাহাফ, আয়াত : ২৮


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন