রামাদান : সদাচার ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার পয়গাম

0
601

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

রামাদানে সিয়াম পালনকারীর মন নরম হয়। হৃদয়ে দয়া ও ভালােবাসার উদ্রেক হয়। আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তার এই দয়া ও ভালােবাসার পাওয়ার সবচেয়ে বড় হকদার হলাে তার পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন। রামাদান একজন মুসলিমকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সে একা নয়; তার অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে। কাজেই তার উচিত হলাে, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা, সদ্ভাব ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং তাদের প্রতি সদাচারণ করা।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

তবে কি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তােমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক চ্ছিন্ন করবে? তাদেরই তাে আল্লাহ লানত করেন এবং করেন বধির ও দৃষ্টিহীন।[1]

উপযুক্ত আয়াত থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা সর্বাপেক্ষা বড় গুনাহ, মহা অপরাধ এবং পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ভঙ্গ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। অপরদিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা সবচেয়ে বড় পুণ্যকর্ম ও মহৎকাজ।

আল্লাহর রাসূল (সাঃ) থেকে সহীহসূত্রে প্রমাণিত, তিনি বলেন—

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।[2]

আত্মীয়তার সম্পর্ককে সৃষ্টি করার পর সে দাঁড়িয়ে আল্লাহর আরশ ধরে বলে, ‘আমাকে ছিন্ন করা’ হতে আশ্রয় চাওয়ার জন্যই আমি তােমার সামনে দাঁড়িয়েছি। আল্লাহ তখন বলেন—

তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, যে-ব্যক্তি তােমার সম্পর্ক বজায় রাখবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখব। আর যে-ব্যক্তি তােমাকে ছিন্ন করবে, আমি তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করব? আত্মীয়তার সম্পর্ক তখন বলে, হাঁ আমি সন্তুষ্ট। আল্লাহ বলেন, এই প্রতিশ্রুতি তােমাকে দেওয়া হলাে।[3]

রাসূল (সাঃ) আরও বলেন—

প্রকৃত সম্পর্ক রক্ষাকারী সে নয়, যে অন্যের সম্পর্ক রক্ষার বিনিময়ে সম্পর্ক রক্ষা করে; বরং প্রকৃত সম্পর্ক রক্ষাকারী সে, যে-কোনাে কারণে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলেও বজায় রাখার চেষ্টা করে।[4]

আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত—

জনৈক সাহাবী বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার কিছু আত্মীয় আছে, আমি তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখি; কিন্তু তারা সম্পর্ক ছিন্ন করে। আমি তাদের প্রতি সদাচার করি; কিন্তু তারা আমার প্রতি দুব্যবহার করে। তার কথা শুনে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, যা বললে, যদি সত্যি সত্যি তাই হয়ে থাকে, তবে তুমি যেন তাদের মুখে উত্তপ্ত বালু ঢালছ। আর জেনে রেখাে, তােমার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক একজন সাহায্যকারী নিযুক্ত থাকবে।[5]

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর অধিকাংশ আত্মীয়ই ছিল তার জানের দুশমন। তারা তাকে বর্ণনাতীত কষ্ট দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। জন্মভূমি ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছে। এতকিছুর পরও আল্লাহ যখন তাকে দুশমনদের ওপর বিজয় দান করেন। তখন তিনি সব কিছু ভুলে তাদের ক্ষমা করে দেন ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত বিরল।

আত্মীয়তার সম্পর্কের সঙ্গে মানুষের আয়ুষ্কালের গভীর ও নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কেউ আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে তার আয়ু বৃদ্ধি পায়। জীবনে শান্তি, স্থিতি ও নিরাপত্তা আসে। ফলে সাওয়াবের কাজ করার বাড়তি সুযােগ পাওয়া যায় এবং উত্তরােত্তর তার সাওয়াব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এছাড়াও আত্মীয়তার সম্পর্ক ঈমানের পূর্ণতা ও আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের প্রমাণ বহন করে। অপমৃত্যু বা অকস্মাৎ মৃত্যু রােধ করে। সর্বোপরি দুনিয়া ও আখিরাতের লাঞ্ছনা ও অপদস্থতা থেকে রক্ষা করে।

একটি আসারে [6] বর্ণিত আছে—

আল্লাহ আমাকে আদেশ করেছেন, যে আমার সাথে সম্পর্ক ছেদ করে আমি যেন তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করি। যে আমাকে বঞ্চিত করে আমি যেন তাকে দান করি। যে আমার প্রতি যুলুম করে আমি যেন তাকে ক্ষমা করি।[7]

পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হলাে মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক। কাজেই সন্তানকে যে-কোনাে মূল্যে এই সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। মা-বাবার সাথে সদাচারণ করতে হবে। তাদের প্রতি কোমল ও বিনম্র হতে হবে। তাদের সম্মান দিতে হবে এবং তাদের জন্য দয়া ও করুণার দুআ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন—

তােমার রব আদেশ দিয়েছেন যে, তােমরা তাকে বাদ দিয়ে অন্য কারও ইবাদাত করবে না এবং মা-বাবার প্রতি সদ্ব্যবহার করবেন। তারা উভয়ে অথবা তাদের কোনাে একজন তােমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের ‘উফ’ শব্দটিও বলাে না এবং তাদের ধমক দিয়াে না। তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলাে। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত হয়ে বলো—হে আমার রব, তাদের প্রতি দয়া করাে, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিল।[8]

হাদীস শরীফে এসেছে—আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত,

জনৈক ব্যক্তি নবী -এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার সদাচারণ পাওয়ার সর্বাধিক হকদার কে? তিনি বললেন, তােমার মা। লােকটি আবার জিজ্ঞেস করল, তার পরে কে? তিনি বললেন, তােমার মা। লােকটি আবার জানতে চাইল, তার পরে কে? তিনি বললেন, তােমার মা। লােকটি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করল, তার পরে কে? তখন তিনি বললেন, তােমার বাবা।[9]

আমার মনে হয়, সৎকর্ম ও আত্মীয়তার সম্পর্ক শেখার ক্ষেত্রে সিয়াম হলাে সবচেয়ে উপযুক্ত সময় ও বড় মাধ্যম। কারণ, রামাদান উত্তম চরিত্রের উন্মেষ ঘটায়। দয়া-অনুগ্রহ এবং প্রেম-ভালােবাসা সৃষ্টি করে। হৃদয় বিগলিত করে। অনুভূতি তীব্র করে এবং মেজাজ শান্ত করে। কাজেই রামাদানে আমরা চাইলেই আত্মীয়-স্বজনদের খবর নিতে পারি। তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারি। তাদের জন্য দুআ করতে পারি এবং বিভিন্ন সময়ে উপহার-সামগ্রী নিয়ে তাদের কাছে উপস্থিত হতে পারি; বরং এটা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।

হে আল্লাহ, আমাদের দ্বীনের জ্ঞান দাও। নবী (সাঃ)-এর সুন্নাহর ওপর অটল রাখাে এবং সঠিক পথে পরিচালনা করাে।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ১১৮ – ১২২


[1] সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত : ২২-২৩
[2] সহীহ বুখারী : ৫৯৮৪; সহীহ মুসলিম: ২৫৫৬
[3] সহীহ বুখারী : ৫৬৬৪; সহীহ মুসলিম : ৪৭৬২
[4] সহীহ বুখারী : ৬৯
[5] সহীহ মুসলিম : ২৫৫৮
[6] সাহাবীদের উক্তিকে আসার বলা হয়।
[7] মিরকাত শরহু মিশকাত : ৫৩৫৮
[8] সূরা ইসরা, আয়াত : ২৩-২৪
[9] সহীহ বুখারী: ৫৯৭১; সহীহ মুসলিম : ২৫৪৮


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন