রামাদানের হারিয়ে যাওয়া সুন্নত আমল – পর্ব ৩

2
1168

লেখকঃ উস্তাদ আলী হাম্মুদা, মোহাম্মাদ ফারিস| সম্পাদনা ও সংযোজনঃ মুওয়াহহিদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ

পর্ব- ১ | পর্ব- ২ | পর্ব-৩

(৯) রাগের লাগাম ধার রাখা 

তাকওয়া চর্চা করার সেরা একটি সময় হল রামাদান আর এই চর্চা আমাদেরকে নিয়ে যায় আরাে বেশি নিজের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করে তােলার দিকে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আমাদেরকে শিখিয়েছেন: “সিয়াম তােমাদের জন্য একটি নিরাপত্তাস্বরূপ। তাই যখন তােমরা সিয়ামত থাকবে, তখন বাজেভাবে বা বােকার মত কোন আচরণ করবে না। আর কেউ যদি তােমার সাথে তর্ক করে বা ঝগড়া বাধিয়ে বসে, তাহলে তাকে বলে দিবে: ‘আমি সায়েম, আমি সায়েম।[1]

যখনই আপনি এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন যা আপনাকে রাগান্বিত হতে বা বিরক্ত হয়ে উঠতে বাধ্য করে নয়তাে ঝগড়া বিগ্রহকে উসকে দেয়, তখন নিজেকে শান্তশিষ্ট রাখার চেষ্টা না করে এই সুযােগটিকে কাজে লাগান। এই যে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করার পুরস্কার আপনি পাবেন সেটা আপনার বর্তমান জীবন আর আগামীর জীবনের জন্যও অনেক, অনেক বড়, অনেক বেশি দীর্ঘস্থায়ী আর অনেক বেশি পরিপূর্ণ।

(১০) সাদাকা করুন হাত খুলে

রামাদানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শিষ্টাচার আর আমলের ব্যাপারে খুব সুন্দর আর শক্তিশালী একটা হাদিস বর্ণিত আছে।

ইবনু আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: “রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছিলেন সকল মানুষের মধ্যে সবচেয়ে দানশীল এবং তাঁর এই দানের হাত আরাে বেশি প্রসারিত হয়ে যেত রামাদান মাসে যখন জিবরাইল আলাইহিস সালাম তাঁর সাথে দেখা করতে আসতেন। জিবরাইল আলাইহিস সালাম রামাদানের প্রতিরাতে রাসূলুল্লাহ -এর সাথে দেখা করতে আসতেন, দুজনে মিলে একসাথে কুরআন তিলাওয়াত করতেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন প্রবাহিত বাতাসের চেয়েও বেশি দানশীল হয়ে যেতেন। [2]

তাই রামাদানে আপনার সাদাকার হাতকে প্রসারিত করতে একটি সুযােগও মিস করবেন না। অনলাইন আর অফলাইন, দুই মাধ্যমেই এই সময়ে প্রচুর সুযােগ থাকে সাদাকা করার জন্য।

(১১) প্রতি সপ্তাহে হাজ্জ আর উমরাহ আদায় করা

না, আমরা আসলেই সপ্তাহে সপ্তাহে হাজ্জ আর “উমরা করার কথা বলছি না। আমরা বলছি নিচের হাদিসে বর্ণিত আমলের কথা।

আনাস ইবনু মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন: আল্লাহর রাসূল (ﷺ) বলেছেন: “যে ব্যক্তি জামাআতের সাথে ফজরের সালাত আদায় করবে, তারপর সূর্য ওঠা পর্যন্ত বসে বসে আল্লাহর যিকর করবে, তারপর উঠে দু’ রাকাত সালাত আদায় করবে, সেটা তার জন্য একটা হাজ্জ আর একটা ‘উমরার সমান সওয়াব নিয়ে আসবে।[3]

হাদিসে বর্ণিত এই কাজটি নিঃসন্দেহে একটি নেক কাজ, যার জন্য আল্লাহ আমাদের পুরস্কৃত করবেন। এটা আরাে এক দিক দিয়ে ভালাে যে যদি আপনি সপ্তাহ জুড়ে ব্যস্ত থাকেন, তাহলে সপ্তাহান্তে আপনি এটা আমল করতে পারেন, যেদিন আপনার তেমন কোন কাজ থাকবে না।

(১২) হাসুন আর মাফ করে দিন

দুইটা কাজ আছে এমন যেগুলাে খুব সহজ, কিন্তু খুব শক্তিশালী।

কিছু কারণে, রামাদানের সময় আমাদের অনেককেই দেখতে খুব বদমেজাজী দেখায়। সাওমের ফলে আমাদের মধ্যে ন, শান্তিপূর্ণ আর সবকিছু সহজে নেওয়ার মানসিকতা গড়ে ওঠা উচিত, উল্টো মেজাজী বা রাগী হওয়া উচিত নয়। নিজেকে এটা মনে করিয়ে দেবার একটি উপায় হল যখনই আপনি অন্যের সাথে সাক্ষাত করবেন তখনই সচেতনভাবে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলুন। যখন রামাদানের দিনগুলােতে আপনার চারপাশের লােকজনের সাথে সহজভাবে চলবেন আর নিজের মধ্যে একটা আশাবাদী স্বভাব ধরে রাখবেন, তখন নিঃসন্দেহে এটা অসাধারণ একটা ব্যাপার হবে। আর রাসূলের সুন্নাহও এটাই।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন: “তােমার ভাইয়ের দিকে মুচকি হাসিটুকুও একটা সাদাকাহ …..[4]

শেষ আরেকটা কথা। আর শেষ কথা হলেও নিশ্চিতভাবেই ছােটখাটো কোন কথা নয়। সেটা হল, মাফ করে দিন সেইসব মানুষগুলােকে যারা আপনার সাথে অন্যায় করেছে।

এই হাদিসটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক: আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে রাসূলুল্লাহ বলেছেন: “সাদাকাহ সম্পদকে কমিয়ে দেয় না এবং যে মাফ করে আল্লাহ তার সম্মান বৃদ্ধি করে দেন আর এমন কেউ নেই যে আল্লাহর খাতিরে বিনম্র হল অথচ আল্লাহ তার মাকামকে উঁচু করে দিলেন না।[5]

চিন্তা করে দেখুন, ক্ষমা করে দিয়ে আপনি যে শুধু লােকের চোখেই বড় হচ্ছেন তাইই না, বরং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার চোখেও আপনার সম্মান বেড়ে যাচ্ছে।

এছাড়াও লাইলাতুল কদরে পড়বার মত একটা দুআ আমাদেরকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে যেখানে বলা আছে যে, “আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন: “আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, “আমি আল্লাহর রাসূল -কে জিজ্ঞেস করলাম, “ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি যদি জানতে পারি কদরের রাত কোনটা, তবে আমি তখন কি পড়বাে?”

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন- “বলাে হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল, আপনি ক্ষমা করতে ভালােবাসেন, অতএব  আমাকে ক্ষমা করে দিন।[6]

এবার ভাবুন তাে, লাইলাতুল কদরে আপনি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইছেন, আর নিজেই আরেকজনের প্রতি মনের ভেতর রাগ পুষে রেখেছেন, তাকে ক্ষমা করে দিতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন, এটা কেমন কথা? তাই, ক্ষমা করে দিন, আশা করা যায়, আল্লাহ আপনাকেও ক্ষমা করে দিবেন।

রামাদান হচ্ছে সম্পর্কগুলোকে আরো একবার জোড়া লাগাবার বিশাল এক সুযােগ। এই মাস হচ্ছে আল্লাহর ওয়াস্তে অন্যকে মাফ করে দেবার সুযােগ। আমাদের অজস্র গুনাহ আর অক্ষমতার জন্য আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার মস্ত বড় এক সুযােগ, সুবিশাল এক দরজা।

যেমনটা বলেছেন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা: “তারা যেন ওদেরকে ক্ষমা করে এবং ওদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা করে। তােমরা কি চাও না যে, আল্লাহ তােমাদেরকে ক্ষমা করুন? আর আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।[7]

অতএব, বেশি বেশি নেক আমল করে এই মাস বাড়িয়ে নিন আপনার আধ্যাত্মিক, ব্যক্তিগত আর সামাজিক শক্তি। একইসাথে নিয়ে আসুন সম্পর্কগুলাের মধ্যে এক সত্যিকারের পরিবর্তন আর এভাবেই একটি রামাদান আমাদের জন্য হয়ে উঠতে পারে জীবন বদলে দেওয়া রামাদান, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে রামাদানের এই সুপার সুন্নাহগুলাে অনুসরণের তাউফিক দিন; শুধু রামাদানেই নয়, সারাবছর। আল্লাহ সুন্নাহগুলােকে মুসলিম সমাজে পুনরুজ্জীবিত করার তাউফিক যেন আমাদের দান করেন। আমিন!!

পর্ব- ১ | পর্ব- ২ | পর্ব-৩

উৎসঃ প্রোডাক্টিভ রামাদান, পৃষ্ঠা: ৯১ – ৯৫


[1] বুখারি, হাদিস-ক্রম : ১৮৯৪; মুসলিম, হাদিস-ক্রম:১১৫১
[2] বুখারি, হদিস-ক্ৰম : ৩২২০
[3] তিরমিযি, হাদিস-ক্রম : ৫৮৬
[4] তিরমিযি, হাদিস-ক্রম : ১৯৫৬, ইবনু হিব্বান, হদিস-ক্রম : ৫২৯
[5] মুসলিম, হাদিস-ক্রম : ২৫৮৮
[6] মুসনাদু আহমাদ, হাদিস-ক্রম : ২৫৩৮৪
[7] সূরা নূর, আয়াত-কম : ২২


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন