রামাদান : দাওয়াতের বরকতময় মৌসুম

0
453

লেখকঃ ড. আইদ আল কারণী | সম্পাদনা ও সংযোজনঃ আকরাম হোসাইন

দাওয়াত অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এটা মূলত নবী-রাসূলদের মিশন। প্রত্যেক নবীই তার সম্প্রদায়কে দাওয়াত দিয়েছেন এবং ইলম শিক্ষা দিয়েছেন। প্রত্যেকেই বলেছেন—

তােমরা আল্লাহর ইবাদাত করাে। তিনি ছাড়া তােমাদের অন্য কোনাে ইলাহ নেই।[1]

প্রত্যেক দাঈ-ই তার সম্প্রদায়কে বলেছেন—

আমি এর বিনিময়ে তােমাদের কাছে কোনাে প্রতিদান চাই না।[2]

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

তুমি আপন প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে। আর (যদি কখনাে বিতর্কের প্রয়ােজন পড়ে তাহলে তাদের সাথে বিতর্ক করবে উৎকৃষ্ট পন্থায়।[3]

অন্যত্র বলেন—

(হে নবী) বলে দিন, এটাই আমার পথ, আমি ‘বাসীরাত’-এর সাথে আল্লাহর দিকে ডাকি এবং যারা আমার অনুসরণ করে তারাও। আল্লাহ (সব রকম) শিরক থেকে পবিত্র। যারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে, আমি তাদের অন্তর্ভুক্ত নই।[4]

উল্লেখ্য যে, উপযুক্ত আয়াতে ‘বাসীরাহ’ বলে উপকারী ইলম এবং নেক আমলকে বােঝানাে হয়েছে।

আরেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন—

তার চেয়ে উত্তম কথা আর কার হতে পারে? যে আল্লাহর দিকে ডাকে, সৎকর্ম করে এবং বলে, আমি আনুগত্য স্বীকারকারীদের একজন।[5]

উল্লেখ্য যে, আল্লাহর দিকে দাওয়াত প্রদানের পাঁচটি আদাব, পাঁচটি উপায় এবং পাঁচটি সুফল রয়েছে।

আদবগুলাে হলাে—

এক. ইখলাস এবং আল্লাহর সঙ্গে সততা। আল্লাহ তাআলা বলেন—

তাদের কেবল এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে।[6]

সহীহ হাদীসে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন—

তিন ব্যক্তিকে প্রথম জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এদের মধ্যে একজন হলাে, এমন আলেম যে মানুষের মাঝে আলেম হিসেবে প্রসিদ্ধি পাওয়ার জন্য ইলম শিখেছে। আর দুনিয়াতে তাকে আলেম বলাও হয়েছে।[7]

দুই. যে-বিষয়ের দাওয়াত দেবে প্রথমে নিজে সে-বিষয়ের ওপর আমল করবে। কারণ, অন্যকে দাওয়াত দেওয়া আর নিজে সে-কাজ থেকে দূরে থাকা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও লজ্জাকর বিষয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

তােমরা কি অন্য লােকদের পুণ্যের আদেশ করাে আর নিজেদের ভুলে যাও অথচ তােমরা কিতাবও তিলাওয়াত করাে। তােমরা কি এতটুকুও বােঝাে না?[8]

তিন. নম্রতা ও কোমলতার সাথে দাওয়াত দেওয়া। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন—

তােমরা তার সাথে নরম ভাষায় কথা বলবে। হয়তাে সে উপদেশ গ্রহণ করবে কিংবা (আল্লাহকে) ভয় করবে।[9]

অন্যত্র বলেন—

(হে নবী,) আল্লাহর রহমতেই তুমি তাদের সাথে কোমল আচরণ করেছ। তুমি যদি রূঢ় প্রকৃতির ও কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হতে, তবে তারা তােমার আশপাশ থেকে সরে গিয়ে বিক্ষিপ্ত হয়ে যেত।[10]

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন—

তােমরা সহজ করাে। কঠিন কোরাে না। সুসংবাদ দাও। আতঙ্কিত কোরাে না।[11]

চার. পর্যায়ক্রমে দাওয়াত দেওয়া। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলাের ব্যাপারে আগে দাওয়াত দেওয়া। স্বয়ং আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-ও এমন করেছেন; অধিকন্তু ইয়ামানে পাঠানাের সময় মুআয রাযিয়াল্লাহু-কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন—

তুমি আহলে কিতাবদের এক সম্প্রদায়ের কাছে যাচ্ছ। প্রথমে তাদের এই সাক্ষ্য দেওয়ার দাওয়াত দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনাে ইলাহ নেই। আমি আল্লাহর রাসূল।’ যদি তারা তা মেনে নেয় তাহলে তাদের জানাবে যে, আল্লাহ তাদের ওপর দিনে-রাতে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করেছেন। [12]

পাঁচ. প্রত্যেককে তার উপযােগী ও প্রয়ােজনীয় ভাষায় সম্বােধন করা। অর্থাৎ গ্রাম্য ও শহুরে ব্যক্তির ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা ভাষা-শৈলী ব্যবহার করা। শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ব্যক্তির সঙ্গে তাদের উপযােগী ভাষা ব্যবহার করা। তার্কিকের সঙ্গে যুক্তিপূর্ণ ভাষায় সুষম শৈলীতে কথা বলা এবং অনুগত ব্যক্তির সাথে সাধারণভাবে দাওয়াত দেওয়া। মহান আল্লাহ বলেন—

বস্তুত যাকে হিকমাহ দান করা হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দান করা হয়েছে। [13]

উপায়গুলাে হলাে—

এক. ব্যক্তিগত দাওয়াত। অর্থাৎ কোনাে ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ কোনাে বিষয়ে পৃথকভাবে দাওয়াত দেওয়া।

দুই. ব্যাপকভিত্তিক দাওয়াত। এটা হতে পারে কোনাে সম্মেলনে। কিংবা কোনাে নসীহার মজলিসে। এ ধরনের দাওয়াতে একসাথে অনেক মানুষের উপকার হয়ে থাকে।

তিন. তালিবে ইলমদেরকে তাদের শাস্ত্রীয় বিষয়ে পাঠদান করা। এটা কেবল বিশেষজ্ঞ আলেমদের কাজ। জনসাধারণের কাজ নয়।

চার. চিঠিপত্র প্রেরণ কিংবা ইসলামী বইপত্র বিতরণের মাধ্যমে। এতেও বিপুলসংখ্যক মানুষের উপকার হয়ে থাকে।

পাঁচ. হকের কালিমাকে উন্নীত করার লক্ষ্যে আধুনিক টেকনােলজি ব্যবহার করা।

সুফলগুলাে হলাে—

এক. নবী-রাসূলদের উত্তরাধিকারীর মর্যাদা লাভ করা। কারণ, তারাই তাে ছিলেন দাওয়াতের মূল জিম্মাদার। তারাই তাে প্রথম দাঈ। দাওয়াতের ক্ষেত্রে তারাই তাে ছিলেন পুরােধা ব্যক্তিত্ব।

দুই. সমুদ্রের মাছ থেকে গর্তের পিপীলিকা পর্যন্ত সৃষ্টিকুলের সকলের ক্ষমাপ্রার্থনা লাভ করা। মানুষকে ভালাে কাজের শিক্ষাদানকারীর ব্যাপারে হাদীসে এমনটিই বর্ণিত হয়েছে।

তিন. বিপুল সওয়াবের অধিকারী হওয়া। কারণ, দাওয়াতগ্রহীতা যে-পরিমাণ নেক আমল করবে দাঈ নিজেও সে-পরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে।

আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে—

কেউ যদি অপরকে সুন্নাতে হাসানার দিকে দাওয়াত দেয় এবং সে এই দাওয়াত কবুল করে তবে দাঈ দাওয়াতগ্রহীতার সমপরিমাণ সাওয়াব লাভ করবে। এতে দাওয়াতগ্রহীতার সাওয়াব মােটেও হ্রাস পাবে না।[14]

চার. দাওয়াত দেওয়ার মাধ্যমে দাঈ গ্রহীতার স্তর থেকে দাতার উচ্চতায় উন্নীত হয়। ফলে সে অন্যের ওপর ভালাে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে এবং অন্যের কুপ্রভাব থেকে রক্ষা করতে পারে।

পাঁচ. মানুষের মাঝে ইমাম ও অনুসরণীয় ব্যক্তি হওয়ার মর্যাদা লাভ করা। কুরআনে কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সালেহীনের বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন, তারা তাদের প্রার্থনায় নিবেদন করে—

আর আপনি আমাদের মুত্তাকীদের ইমাম বানিয়ে দিন।[15]

রামাদানে দাঈদের দাওয়াত দেওয়ার সুযোেগ অনেক বেড়ে যায়। তাদের কথা বলার অনেক ক্ষেত্র তৈরি হয়। মানুষের দিল নরম থাকে। ভালাে কথা শােনার প্রতি এবং সুন্দর লেখা পড়ার প্রতি তাদের প্রচণ্ড আগ্রহ থাকে। আছে কি এমন কোননা দাঈ—যিনি এই বরকতময় মাসে সৎ কাজের দিকে আহ্বান করবেন? মানুষকে তার ইলম দ্বারা উপকৃত করবেন?

হে আল্লাহ, আপনি আমাদের অধিক পরিমাণে উপকারী ইলম দান করুন। বেশি বেশি নেক কাজ করার তাওফীক দান করুন এবং আমাদের সহীহ দ্বীনের বুঝ দান করুন।

উৎসঃ ভালোবাসার রামাদান, পৃষ্ঠাঃ ১৫৮ – ১৬৪


[1] সূরা মুমিনুন, আয়াত : ৩২
[2] সূরা শুআরা, আয়াত : ১২৭
[3] সূরা নাহল, আয়াত : ১২৫
[4] সূরা ইউসুফ, আয়াত : ১০৮
[5] সুরা ফুসসিলাত, আয়াত : ৩৩
[6] সূরা বাইয়িনা, আয়াত : ৫
[7] সহীহ মুসলিম : ১৯০৫
[8] সূরা বাকারা, আয়াত : ৪৪
[9] সূরা ত-হা, আয়াত : ৪৪
[10] সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ১৫৯
[11] সহীহ বুখারী : ৬৯; সহীহ মুসলিম : ৩৩৬৫
[12] সহীহ বুখারী : ৬৮৫১; সহীহ মুসলিম :১৯
[13] সূরা বাকারা, আয়াত : ২৬৯
[14] সহীহ মুসলিম : ৪৮৩৭
[15] সূরা ফুরকান, আয়াত : ৭৪


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

আপনার মন্তব্য লিখুন