নবী (সাঃ) যেভাবে হজ করেছেন পর্ব- ২

19
2292

সংকলনঃ শাইখ মুহাম্মাদ নাসেরুদ্দীন আল-আলবানী (রহ)অনুবাদঃ মুফতী নুমান আবুল বাশার, ড. এটিএম ফখরুদ্দীন

পর্ব- ১ | পর্ব- ২ | পর্ব- ৩ | পর্ব- ৪ | পর্ব- ৫ 

হজকে উমরায় পরিণত করার আদেশ

মারওয়া পাহাড়ে শেষ চক্করকালে তিনি বললেন, হে লোকসকল! “আমি পরে যা বুঝেছি তা যদি আগে বুঝতে পারতাম, তাহলে হাদী বা কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে আসতাম না এবং হজকে উমরায় পরিণত করতাম। তোমাদের মধ্যে যার সাথে হাদী বা পশু নেই সে যেন হালাল হয়ে যায় এবং এটাকে উমরায় পরিণত করে।[38]

অন্য বর্ণনায় এসেছে: “বায়তুল্লাহর তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ার মাঝে সা‘ঈ করে তোমরা তোমাদের ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাও এবং চুল ছোট করে ফেল। অতপর হালাল হয়ে অবস্থান কর। এমনিভাবে যখন তারবিয়া দিবস[39] (যিলহজের আট তারিখ) হবে, তখন তোমরা হজের ইহরাম বেঁধে তালবিয়া পাঠ কর। আর তোমরা যে হজের ইহরাম করে এসেছ, সেটাকে তামাত্তুতে পরিণত কর।[40]

তখন সুরাকা ইব্‌ন মালিক ইব্‌ন জু‘শুম রা. মারওয়া পাহাড়ের পাদদেশে ছিলেন, তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদের এই উমরায় রূপান্তর করে তামাত্তু করা কি শুধু এ বছরের জন্য নাকি সব সময়ের জন্য? তখন নবী ﷺ দু’হাতের আঙ্গুলগুলো পরস্পরের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে বললেন: “হজের ভেতরে উমরা কিয়ামত দিন পর্যন্ত প্রবিষ্ট হয়েছে। না, বরং তা সবসময়ের জন্য, না, বরং তা সবসময়ের জন্য এ কথাটি তিনি তিনবার বললেন।[41]

সুরাকা ইব্‌ন মালিক রা. বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমাদেরকে দীনের ব্যাখ্যা দিন, আমাদেরকে যেন এখনই সৃষ্টি করা হয়েছে (অর্থাৎ আমাদেরকে সদ্যভূমিষ্ট সন্তানের ন্যায় দীনের তালীম দিন)। আজকের আমল কিসের ওপর ভিত্তি করে? কলম যা লিখে শুকিয়ে গিয়েছে এবং তাকদীর যে বিষয়ে অবধারিত হয়ে গিয়েছে, তার ভিত্তিতে? [42] না কি ভবিষ্যতে রচিতব্য নতুন কোন বিষয়ের ভিত্তিতে? তিনি বললেন: “না, বরং যা লিখে কলম শুকিয়ে গিয়েছে এবং যে ব্যাপারে তাকদীর নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে, তা-ই তোমরা আমল করবে। তিনি বললেন, তাহলে আর আমলের দরকার কী?” [43]

তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন: [اعْمَلُوا فَكُلٌّ مُيَسَّرٌ لِمَا خُلِقَ لَهُ [44

‘তোমরা আমল করে যাও, তোমাদের কেউ যে জন্য সৃষ্ট হয়েছ তার জন্য সে কাজ করা সহজ করে দেয়া হয়েছে। [৪৫]

জাবের (রা.) বলেন, তিনি আমাদেরকে আদেশ দিলেন, আমরা হালাল হয়ে গেলে যেন হাদীর ব্যবস্থা করি। [46] আমাদের মধ্য থেকে এক উটে সাতজন অংশ নিতে পারে।[47] যার সাথে হাদী নেই সে যেন হজের সময়ে তিনদিন রোযা রাখে আর যখন নিজ পরিবারের নিকট অর্থাৎ দেশে ফিরে যাবে তখন যেন সাতদিন রোযা রাখে।[48] অতপর আমরা বললাম, কী হালাল হবে? তিনি বললেন, সব কিছু হালাল হয়ে যাবে। [49]

বিষয়টি আমাদের কাছে কঠিন মনে হল এবং আমাদের অন্তর সংকুচিত হয়ে গেল।[50] বাতহা নামক জায়গায় অবস্থান

জাবের (রা.) বলেন: “আমরা বের হয়ে বাতহা নামক স্থানে গেলাম।” [51] তিনি বলেন, এমতাবস্থায় এক লোক বলতে লাগল, আজকে আমার পরিবারের সাথে আমার সাক্ষাতের পালা। [52]

জাবের রা. বলেন, আমরা পরস্পর আলোচনা করতে লাগলাম। অতপর আমরা বললাম, আমরা হাজী হিসেবে বের হয়েছিলাম। হজ ছাড়া আমরা অন্য কিছুর নিয়ত করিনি। এমতাবস্থায় আমাদের কাছে আরাফা দিবস আসতে যখন আর মাত্র চার দিন বাকী।[53] এক বর্ণনায় এসেছে,” পাঁচ রাত্রি, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন, যেন আমরা আমাদের স্ত্রীদের সাথে মিলিত হই। অতপর আমরা আরাফার উদ্দেশ্যে (মিনা) গমন করি, অথচ আমাদের পুরুষাঙ্গগুলি সবে মাত্র বীর্যস্খলন করেছে। জাবের রা. এটি হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে দেখাচ্ছিলেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি যেন জাবের রা. এর কথার সাথে হাত দিয়ে ইঙ্গিত করে দেখানোর ব্যাপারটি দেখতে পাচ্ছি। মোট কথা, তাঁরা বললেন, আমরা কিভাবে তামাত্তু করব অথচ আমরা শুধু হজের নাম উল্লেখ করেছি। [54]

জাবের (রা.) বলেন: “বিষয়টি নবী ﷺএর কাছে পৌঁছল। আমরা জানি না এটা কি আসমান থেকে তাঁর নিকট পৌঁছল নাকি মানুষের নিকট থেকে পৌঁছল।[55]

হজকে উমরায় পরিণত করার জোর তাগিদ দিয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ভাষণ এবং সাহাবীগণের তাঁর আনুগত্য। অতপর রাসূলুল্লাহ ﷺ দাঁড়িয়ে [56] মানুষের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি আল্লাহর প্রশংসা ও গুণাবলি বর্ণনা করে বললেন,[57] হে মানুষ, তোমরা কি আমাকে আল্লাহ সম্পর্কে জ্ঞান দিচ্ছ? [58] তোমরা জানো, নিশ্চয় আমি তোমাদের চেয়ে আল্লাহকে বেশি ভয় করি, তোমাদের চেয়ে অধিক সত্যবাদী, তোমাদের চেয়ে অধিক সৎকর্মশীল।আমি তোমাদেরকে যা নির্দেশ করছি তা পালন কর[59] আমার সাথে যদি হাদী (যবেহের পশু) না থাকত, তাহলে আমি অবশ্যই হালাল হয়ে যেতাম যেরূপ তোমরা হালাল হয়ে যাচ্ছ। কিন্তু যতক্ষণ না হাদী তার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছবে, [অর্থাৎ দশ তারিখ হাদী যবেহ না হবে] ততক্ষণ আমার পক্ষে হারামকৃত বিষয়াদি হালাল হবে না।[60] যদি আমি পরে যা জেনেছি পূর্বেই তা জানতাম, তাহলে হাদী সাথে নিয়ে আসতাম না। অতএব, তোমরা হালাল হয়ে যাও।[61]

জাবের (রা.) বলেন, আমরা আমাদের স্ত্রীদের সাথে সহবাস করলাম এবং সুগন্ধি ব্যবহার করলাম।[62] আমরা আমাদের স্বাভাবিক পোশাক-পরিচ্ছদ পরিধান করলাম। আমরা রাসূলুল্লাহ ﷺএর কথা শুনলাম এবং মেনে নিলাম।[63] অতপর নবী ﷺ নিজে এবং যাদের সাথে হাদী ছিল [64] তারা ছাড়া সবাই হালাল হয়ে গেল এবং চুল ছোট করল।[65]

পর্ব- ১ | পর্ব- ২ | পর্ব- ৩ | পর্ব- ৪ | পর্ব- ৫ 

চলবে……………

……………………………………………………………………………………………..


[38] সাহাবীদের মধ্যে যারা হাদী সঙ্গে নিয়ে আসেননি রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁদেরকে উমরা করে হালাল হতে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তাদের হজ মুশরিকদের বিপরীত হয়। কেননা মুশরিকরা মনে করতো, হজের মাসসমূহে উমরা পালন জঘন্যতম অপরাধ (বুখারী : ৭২৩০)।
[39] ৮ যিলহজকে ইয়াওমুত তারবিয়া বলা হয়। ইয়াওমুত-তারবিয়া অর্থ পানি পান করানোর দিন। মিনায় পানি ছিল না বলে এদিন হাজীরা পানি পান করে নিতেন, সাথেও নিয়ে নিতেন এবং তাদের বাহন জন্তুগুলোকেও পানি পান করাতেন। তাই এই দিনকে পান করানোর দিন বলা হয়। ইব্ন কুদামা, আল-মুগনী : ৩১৪।
[40] বুখারী ও মুসলিম।
[41] ইবন জারূদ, আল-মুনতাকা।
[42] অর্থাৎ, আমাদের কর্মকান্ড কি আগেই নির্ধারিত নাকি আমরা সামনে যা করব সেটাই চূড়ান্ত?
[43] মুসনাদে আহমদ।
[44] অর্থাৎ তাকদীরে যদি ভালো লিখা হয়ে থাকে, তাহলে ভাল কাজ করা তার জন্য সহজ হবে। আর যদি তাকদীরে খারাপ লিখা থাকে, তবে খারাপ কাজ করা তার জন্য সহজ করে দেয়া হবে।
[45] মুসনাদে আহমদ।
[46] মুসলিম, মুসনাদে আহমদ।
[47] মুসনাদে আহমদ।
[48] মুয়াত্তা, বায়হাকী।
[49] মুসনাদে আহমদ, তাহাবী।
[50] মুসনাদে আহমদ, নাসাঈ।
[51] বায়তুল্লাহর পূর্বদিকে অবস্থিত।
[52] মুসনাদে আহমদ।
[53] মুসনাদে আহমদ।
[54] বুখারী, মুসলিম।
[55] মুসলিম।
[56] মুসলিম, তাহাবী, ইবন মাজা।
[57] মুসনাদে আহমদ, তাহাবী।
[58] বুখারী।
[59] বুখারী, মুসলিম।
[60] বুখারী।
[61] মুসলিম, ইবন মাজা, তাহাবী।
[62] মুসলিম, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ।
[63] মুসলিম, তাহাবী।
[64] যাদের সাথে হাদী ছিল তাঁরা হলেন, রাসূল ﷺ., তালহা রা., আবু বকর রা., উমর রা., যুল-ইয়াসারা রা. ও যুবাইর রা.। সুতরাং তাঁরা কিরান হজ করেছেন। এরা ছাড়া সবাই তামাত্তু হজ করেছেন (বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমদ)।
[65] ইবন মাজা, তাহাবী।

Source: IslamHouse.Com


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

19 COMMENTS

আপনার মন্তব্য লিখুন