অনুবাদ: মোঃ মুনিমুল হক
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহ্মাতুল্লাহ
নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য। দরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা) এবং তাঁর পরিবার ও সঙ্গী-সাথীদের উপর। মহাগ্রন্থ কুর’আন আল কারীমে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” [সূরা লোকমান; ৩১:১৮]
“অহংকার পতনের মূল”-এই প্রবাদটি মোটামুটি আমাদের সকলের জানা। কিন্তু আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন এবং তাঁর রাসূল (সা:) এ ব্যাপারে কি বলেছেন তা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। চলুন, জানার চেষ্টা করি কুর’আন ও হাদীস কি বলে এ ব্যাপারে!
আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ (রা:) থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা:) বলেছেনঃ “যার অন্তরে অণু পরিমান অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা।” এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলঃ যদি কেউ সুন্দর জামা আর সুন্দর জুতা পরিধান করতে ভালবাসে? তখন নবী করীম (সা) বললেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সুন্দর এবং তিনি সৌন্দর্যকে পছন্দ করেন। অহংকার মানে হল সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করা।” [সহীহ্ মুসলিম; কিতাবুল ঈমান, অধ্যায়ঃ ১, হাদীস নম্বরঃ ১৬৪]
অহংকারীর ঠিকানা হল জাহান্নাম। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “সুতরাং,তোমরা দ্বারগুলি দিয়ে জাহান্নামে প্রবেশ কর, সেখানে স্থায়ী হবার জন্যে; দেখ অহংকারীদের আবাসস্থল কত নিকৃষ্ট।” [সূরা নাহল; ১৬:২৯]
তাছাড়া উপরে বর্ণিত হাদীস থেকেও এটা পরিষ্কার বুঝা যায় যে, যার অন্তরে অণু পরিমান অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবেনা। আর এতেই প্রমানিত হয় যে, অহংকার মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায় এবং জান্নাতে যাওয়া পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া রাসূল (সা:) এর এই হাদীসে অহংকার বলতে কি বুঝায় তার পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা খুব সুন্দরভাবে দেওয়া আছে। এই হাদীস অনুযায়ী অহংকার দুই ধরনেরঃ
১. সত্য প্রত্যাখ্যান করাঃ সত্য প্রত্যাখ্যান করা বা তা গ্রহন না করাই হল অহংকার বা দাম্ভিকতা। তাই মহান আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন কুর’আন আল কারীমে প্রিয় নবী (সা:) এর মাধ্যমে যে সত্য আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন তা বিনয়ের সাথে গ্রহন করা এবং মেনে চলা আমাদের জন্য ফরজ। আর যারাই কিনা অহংবোধ আর দাম্ভিকতার কারনে আল্লাহ্ এবং তার রাসূল (সা:) এর বাণী ও বিধানে বিশ্বাস স্থাপনে অপারগতা প্রকাশ করে এবং তা মেনে চলতে অনীহা প্রকাশ করে তারাই হল কাফির বা অবিশ্বাসী। তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম, যেখানে তারা অনন্তকাল থাকবে। কারন, নবী-রাসূলদের মাধ্যমে তাদের কাছে যখন সুস্পষ্ট প্রমানসহ সত্য (কুর’আন ও আসমানী কিতাবসমূহ) পাঠানো হয়েছিল, তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছিল; অহংবোধ ও দাম্ভিকতা তাদেরকে সত্য গ্রহন করা থেকে বিরত রেখেছিল। কুর’আন আল কারীমে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “যখনতার নিকট আমার আয়াতসমূহআবৃত্তি করা হয়, তখনসে দম্ভভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, যেনসে এটা শুনতেই পায়নি, যেন তার কর্ণদুটি বধির।অতএব, তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিয়ে দাও।” [সূরা লোকমান; ৩১:৭]
“যারা নিজেদের নিকট কোন দলীল না থাকলেও আল্লাহ্র নিদর্শন সম্পর্কে বিতর্কে লিপ্ত হয়, তাদের আছে শুধু অহংকার, যা সফল হবার নয়। অতএব,আল্লাহ্র শরণাপন্ন হও; তিনিতো সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” [সূরা আল-মু’মিন; ৪০:৫৬]
অন্য এক আয়াতে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “ভূ-পৃষ্ঠে দম্ভভর বিচরণ করো না। তুমিত কখনোই পদাভরে ভূ-পৃষ্ঠকে বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না।” [সূরা বানী ইসরাইল, ১৭:৩৭]
তবে যাদের ঔদ্ধত্য এবং অহংবোধ তাদেরকে পরিপূর্ণভাবে সত্য গ্রহণ করা থেকে বিরত রাখে-অর্থাৎ যারা মতের অমিলের কারনে বা খেয়াল-খুশিমত সত্য আংশিকভাবে মেনে চলে এবং আংশিক মেনে চলা থেকে বিরত থাকে-তারা কাফির নয়। তবে তাদের দাম্ভিকতার জন্যও রয়েছে যথাপোযুক্ত শাস্তি। আর একারনেই আলেমরা এই ব্যাপারে একমত যে, যখন কেউ আল্লাহ্র রাসূল (সা) এর সুন্নাহ্ সম্পর্কে অবগত হয় তখন তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া তার পক্ষে সমীচীন নয়; ঠিক তেমনি সমীচীন নয় তার উপরে অন্য কারোর কথা বা কাজকে প্রাধান্য দেওয়া সে যেই হোক না কেন-যত প্রভাবশালী ব্যক্তিই হোক না কেন। তাই প্রকৃত জ্ঞান অন্বেষণকারীদের কর্তব্য হল অন্য কারো কথার আগে আল্লাহ্ এবং তাঁর রাসূলের (সা:) কথাকে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য দেওয়া; তারা কি বুঝাতে চেয়েছেন তা গভীরভাবে অনুভবের ও অনুসন্ধানের চেষ্টা করা এবং তার উপর ভিত্তি করে চিন্তাভাবনা করা, মতামত প্রদান করা ও জ্ঞান চর্চায় অগ্রসর হওয়া। কেউ এই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম (Golden Rule) মেনে সত্য উদ্ঘাটনে অগ্রসর হলে তার জন্য রয়েছে কল্যাণ আর সফলতা। আর তা করতে গিয়ে কোন ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে, ইনশাআল্লাহ্। কেননা, তার একমাত্র উদ্দ্যেশই ছিল সত্যকে সঠিকভাবে জানার এবং তা মেনে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। আর এটাই হল বিনয়ের সাথে সত্য গ্রহন করা।
২. মানুষকে হেয় প্রতিপন্ন করাঃ এই ধরনের অহংকারের অন্তর্ভুক্ত হল মানুষকে অবজ্ঞা করা, তাদের ঘৃণা করা, নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ মনোভাব পোষণ করা এবং অন্যদের ছোট/ নিচু মনে করা, অন্যকে ছোট প্রমানিত করার উদ্দ্যেশ্যে নিজেকে জাহির করা, বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করা ইত্যাদি। এই ধরনের মনোভাবের/অহংকারের সূচনা হয় যখন মানুষ নিজেকে অনেক বড় মনে করে, নিজের সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারনা পোষণ করে, নিজেকে অন্য সবার চাইতে উত্তম মনে করে; আর এটাই তাকে উদ্বুদ্ধ করে আল্লাহ্র সৃষ্টিকে ঘৃণা, অবজ্ঞা আর হাসিঠাট্টা করতে। যেটা প্রতীয়মান হয় তার কথা এবং কাজে। এই অহংকারের ব্যাপারে কুর’আন আল কারীমে আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ “(অহংকারবশে) তুমি মানুষ হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না এবং পৃথিবীতেউদ্ধতভাবে বিচরণ করো না; কারণ আল্লাহ কোন উদ্ধত, অহংকারীকে পছন্দ করেন না।” [সূরা লোকমান, ৩১:১৮]
সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত এক হাদিসে প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা:) বলেছেনঃ“একজন মুসলিমের জন্য এটা অনেক বড় একটি গুনাহের কাজ যদি সে তার অপর এক মুসলিম ভাইকে অশ্রদ্ধা/অবজ্ঞার চোখে দেখে।” [সহীহ্ মুসলিম; অধ্যায়ঃ ৩২, হাদীস নম্বরঃ ৬২১৯]
আর এই কারনেই হাদীসে উল্লেখিত লোকটি জিজ্ঞাসা করেছিল, যদি কেউ সুন্দর জামা আর সুন্দর জুতা পরিধান করতে ভালবাসে/গর্ববোধ করে তবে তারও শাস্তি হবে কিনা। তখন রাসূল (সা:) তাকে বলেছিলেন যে যেহেতু লোকটি সত্য প্রত্যাখ্যান করেনি বা কাউকে অবজ্ঞা করেনি তাই ওটাকে অহংকার বলা যাবেনা। তাছাড়া সত্তা, কর্ম এবং গুনাবলীতে আল্লাহ্ নিজে যেমন সুন্দর, ঠিক তেমনি অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয় প্রকারের সৌন্দর্যকেই ভালবাসেন তিনি।
এখানে বাহ্যিক সৌন্দর্যের অর্থ হল শরীর, পোশাক-পরিচ্ছদ ও পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা এবং পবিত্রতা। আর আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বলতে বুঝানো হয়েছে চারিত্রিক দৃঢ়তা। আর তাই প্রায়সময় নবী করীম (সা:) এই বলে প্রার্থনা করতেন যেঃ “হে আল্লাহ! তুমি আমার চরিত্র ও আচার-ব্যবহারকে সুন্দর করে দাও; এ ব্যাপারে তুমি ছাড়া আমার আর কোন সাহায্যকারী নেই। আর দূরে সরিয়ে রাখ আমার নিকট থেকে সকল মন্দকাজ এবং মন্দগুনাবলী; এই বিষয়েও তুমি ব্যতীত আমার অন্যকোন সাহায্যকারী নেই”। [আন-নাসাঈ; হাদীস নম্বরঃ ৮৬১; আল্লামা নাসিরুদ্দীন আল আলবানি (রঃ) তাঁর “কিতাবুস্ সীফাত” (পৃষ্ঠা-৯৩) তে হাদীসটিকে সহীহ্ বলে উল্লেখ করেছেন]
তাই আসুন, আমাদের প্রিয় নবী (সা:) এর মত আমরাও সাহায্য প্রার্থনা করি আল্লাহ্র কাছে, যেন তিনি আমাদের চরিত্রকে সুন্দর করে দেন এবং দূর করে দেন আমাদের অন্তরের যাবতীয় অহংকার আর দাম্ভিকতা; যেন বাঁচিয়ে রাখেন আমাদের সবাইকে জাহান্নামের ভয়াবহ আযাব থেকে যার জ্বালানী হবে পাথর আর মানুষ; সর্বোপরি, আল্লাহ্ যেন আমাদেরকে জান্নাতের পথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীনের প্রতিশ্রুতিই হলঃ “এটা আখিরাতের সে আবাস যা আমি নির্ধারিত করি তাদের জন্যে যারা পৃথিবীতে উদ্ধত হতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য।” [সূরা আল কাসাস্; ২৮:৮৩]
ধৈর্যসহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহু খইরন!
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]
খুব ভাল এক্তা বিষয় জাতে পারলাম…।তাই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি
Zazhakallhu khairan.
হে আল্লাহ আমার মনের অহংকারের, দাম্ভিকতার শেষ বিন্দুটুকুও তুমি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দাও।