শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসায়মীনের রহিমাহুল্লাহ “শারহুল আকীদাহ আল ওয়াসিত্বিয়্যাহ” (২/২৯৭-৩০৬) থেকে অনূদিত।
শায়খ ইবন উসায়মীন বলেন: “ওলীদের কারামত তাৎপর্যময় একটি বিষয় যাতে সত্যকে বাতিল থেকে পৃথক করে অবগত হওয়া উচিৎ।” এটা কি সত্যসত্যই প্রমাণিত নাকি বানোয়াট বিষয়? গ্রন্থকার (রহিমাহুল্লাহ) এটি আহলুস সুন্নাহর বক্তব্য উক্ত করার মাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন: “আহলুস সুন্নাহর উসুলের একটি হচ্ছে: ওলীদের কারামত সত্য বলে স্বীকার করা।”
প্রশ্ন:
এই ওলীরা কারা?
উত্তর:
আল্লাহ তা’আলা এটি তাঁর এই বাণীতে স্পষ্ট করেছেন – “শোনো! আল্লাহর ওলীদের কোন ভয় নেই, তারা চিন্তিতও হবে না। যারা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে।” [ইউনুস: ৬৩]
শায়খুল ইসলাম ইবন তায়মিয়্যাহ রহিমাহুল্লাহ বলেন: “যেই ব্যক্তিই মুমীন ও তাকওয়াধারী, সেই আল্লাহর একজন ওলী।”
ওয়ালায়াত বা ওলীত্ব কোন দাবী-দাওয়া কিংবা আশা-আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে আসে না, বরং ওয়ালায়াত আসে ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে। যদি আমরা কোন লোককে দেখি যে বলছে: “সে একজন ওলী! তবে সে আল্লাহ তা’আলা প্রতি তাকওয়াবান নয়। তবে তার এই কথা তার দিকেই নিক্ষিপ্ত করা হবে।”
আর, কারামাত হচ্ছে কারামাহ শব্দের বহুবচন। কারামাহ হল স্বাভাবিকের সাংঘর্ষিক অলৌকিক ঘটনা যা আল্লাহ তা’আলা কোন ওলীর হাতে ঘটান। তার বলবৃদ্ধি করতে কিংবা সহায়তা করতে কিংবা দৃঢ়পদ করতে কিংবা দীনের সাহায্য করতে।
যেই লোকের মাধ্যমে আল্লাহ তার ঘোড়াকে মৃত্যুর জীবিত করেছিলেন তার নাম হচ্ছে সিলাহ বিন হিশাম। এমনকি তিনি এই পুনরজ্জীবিত ঘোড়ায় করে পরিবারের কাছে পৌঁছান। পৌঁছার পর তিনি তার ছেলেকে বলেন: ঘোড়া থেকে এর জিন নামিয়ে ফেল, কেননা এটি শূন্য। ছেলে যখন জিন সরিয়ে ফেলে, তখন ঘোড়া মৃত অবস্থায় ভূলুণ্ঠিত হয়। [1] এটি একটি কারামত যা এই ব্যক্তির সাহায্যের জন্য ছিল।
যেই কারামতের মাধ্যমে ইসলামের বিজয় ও সাহায্য হয় তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে যা আল ‘আলা বিন আল হাদ্বরামী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুর ক্ষেত্রে ঘটেছিল যখন তিনি সমুদ্রের পানি পাড়ি দিয়েছিলেন এবং একইভাবে সা’দ বিন আবী ওয়াক্কাস রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুর ক্ষেত্রে দাজলা নদী পাড়ি দেয়ার সময়ে। এই দুইজনের ঘটনা ইতিহাসখ্যাত।
সুতরাং কারামত হচ্ছে অলৌকিক ঘটনা। যে ঘটনা লৌকিকতা বা স্বাভাবিকের অনুযায়ী হয়, তা কারামত নয়।আর এই বিষয় আল্লাহ তা’আলা কেবল ওলীর হাতে ঘটিয়ে থাকেন, যাদু কিংবা ছলছাতুরী থেকে এটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। যদিও এসব অলৌকিক ঘটনা, কিন্তু এটি আল্লাহর ওলী নয় বরং আল্লাহর দুশমনদের হাতে ঘটে। সুতরাং এটি কারামত না। এজাতীয় কারামতের দাবী-দাওয়া অনেক বেশি করা হয় এবং বলা হয় যে, এগুলো হচ্ছে এই বাটপারদের কারামত যারা কিনা আল্লাহর পথে বাধাদান করছে। সুতরাং সমাধান হচ্ছে তাদের থেকে এবং মানুষের বুদ্ধি ও চিন্তাভাবনা নিয়ে তাদের খেল-তামাশা থেকে সতর্কতা অবলম্বন।
কারামত কুরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে প্রমাণিত বিষয়। যেমনটি আসহাবে কাহফের ঘটনায় এসেছে যারা মুশরিক জাতির মাঝে বসবাস করছিল। তারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে এবং আশঙ্কা করে যে জাতি তাদের উপর আধিপত্য বিস্তার করবে। তাই তারা এলাকা থেকে আল্লাহ আযযা ওয়াজ্জালের উদ্দেশ্যে মুহাজির হিসেবে বেরিয়ে পড়ে এবং আল্লাহ তাদের জন্য পাহাড়ে একটি গুহার খোঁজ সহজ করে দেন। এই গুহার মুখ ছিল দক্ষিণে ফলে সুর্যের আলো এতে প্রবেশ করে তাদের শরীরের ক্ষতি করত না, আবার তারা আলো থেকে বঞ্চিতও হত না। যখন সূর্য উঠত এটি তাদের গুহার ডান দিক হয়ে অতিক্রম করত এবং যখন অস্ত যেত বাম দিক দিয়ে তাদের পাশ কেটে নুয়ে পড়ত। তারা গুহার প্রবেশদ্বারে ছিল এবং এতে তারা তিনশত এবং নয় বছর অধিক ঘুমন্ত অবস্থায় অবস্থান করে। আল্লাহ তাদেরকে ডানে বামে পাশ ফিরিয়েছেন। এভাবে তারা শীত-গ্রীষ্ম পাড়ি দিয়েছে। না তারা গরমের অতিষ্ট হয়েছে, না শীতের যাতনা ভোগ করেছে। তারা ক্ষুধার্ত হয় নি, তৃষ্ণার্তও হয় নি। তাদের ঘুমাতে ঘুমাতে ক্লান্তও হয় নি। কোন সন্দেহ ছাড়াই এটি একটি কারামত। এভাবেই তারা বজায় থাকে। অবশেষে আল্লাহ তাদের জাগ্রত করেন এমন এক যুগে যখন সেই এলাকা থেকে শিরক দূর হয়ে গিয়েছিল। এভাবে তারা শিরক থেকে নিরাপত্তা লাভ করে। এছাড়াও রয়েছে মারিয়াম রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহার ঘটনা। আল্লাহ এর মাধ্যমে তাকে কারামত প্রদান করেছেন। এমনকি প্রসববেদনা তাকে খেজুর গাছের কাণ্ড পর্যন্ত নিয়ে যেতে বাধ্য করে। আল্লাহ তালে তখন আদেশ দেন কাণ্ড ধরে নাড়া দিতে যেত তার নিকটে খেজুর ঝড়ে পড়ে। এছাড়াও রয়েছে সেই ব্যক্তির ঘটনা যাকে আল্লাহ একশত বছর মৃত রেখে পুনরায় জীবিত করেন যা ছিল তার জন্য কারামত। আল্লাহ তা’আলা এর মাধ্যমে তাঁর ক্ষমতা তার কাছে স্পষ্টমান করেন এবং তার ঈমানে দৃঢ়তা বাড়িয়ে দেন।
আর সুন্নাহতে যেই কারামতগুলো আছে তা সংখ্যায় প্রচুর। সহীহুল বুখারীর নবীদের অধ্যায়ে বনী ইসরাইলের ঘটনা সম্পর্কে যা এসেছে তা দেখে নিতে পারেন। এছাড়াও শায়খুল ইসলাম ইবন তায়মিয়্যাহ রচিত “আল ফুরকান: রহমানের বন্ধু ও শয়তানের বন্ধুদের তফাৎ” বইটি। বাস্তবতাও কারামতের সত্যতার সাক্ষ্য প্রদান করে। এটা প্রকাশ্য একটি বিষয়। ব্যক্তি তাঁর যুগেই এ সম্পর্কে জানতে পারে। হয়ত চাক্ষুষ দেখার দ্বারা কিংবা সত্য সুত্রে সংবাদের দ্বারা।
সুতরাং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের মাযহাব হচ্ছে ওলীদের কারামত সত্য বলে স্বীকার করা। এদিকে আহলুস সুন্নাহর মাযহাব বিরোধী মাযহাবও রয়েছে। তা হচ্ছে মু’তাযিলা ও এক্ষেত্রে তাদের অনুসরণকারীদের মাযহাব। এমনকি তারা কারামত অস্বীকার করেছে এবং বলেছে – যদি কারামত প্রমাণিত বিষয় হত, তাহলে তো যাদুকরের সাথে ওলীর এবং ওলীর সাথে নবীর সামঞ্জস্য হয়ে যায়! কেননা এদের সবাই অলৌকিক ঘটনা নিয়ে এসেছে। তাদের জবাবে বলা হবে: প্রতারিত হওয়া সম্ভব নয়, কেননা কারামত হয় ওলীর হাতে এবং ওলীর পক্ষে কখনো নবুওত দাবী করা সম্ভব নয়। যদি সে দাবী করে বসে, তবে সে কোন ওলী নয়। নবীর আয়াত বা নিদর্শন কেবল নবীর হাতেই হয়। আর ছলছাতুরী এবং যাদু এসব হয় আল্লাহর শত্রুদের হাতে যারা আল্লাহর ওয়ালায়াত থেকে বহুদূর। এদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মূলত শয়তানদের সহযোগিতা হয়। এরা এদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এটি অর্জন করে। অপরদিকে কারামত এর বিপরীত। কেননা এটি আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে ঘটে। ওলী তার কোন কাজের মাধ্যমে এর অনুসন্ধান করে না। আলেম-উলামা বলেন: কোন ওলীর প্রত্যেকটি কারামত হচ্ছে সে যে নবীর অনুসারী তার আয়াত বা নিদর্শন। কেননা কারামত হচ্ছে আল্লাহ আযযা ওয়াজাল্লের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে সাক্ষ্য প্রদান যে, এই ওলী সত্যপথে রয়েছে।
সুতরাং এর উপর ভিত্তি করে বলা যায়: এই উম্মতের ওলীদের দ্বারা যেসব কারামত সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো আল্লাহর রাসূলেরই নিদর্শন। সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। একারণেই কতিপয় উলামা বলেছেন: পূর্বের নবীদের নিদর্শনগুলোর মধ্যে এমন কোন নিদর্শন নেই যার ঠিক অনুরূপ নিদর্শন আল্লাহর রাসূলেরও নেই। সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাদেরকে সামনে যখন বলা হয়ে যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো আগুনে নিক্ষিপ্ত হবার পর ইব্রাহীমের ন্যায় জীবন্ত বেরিয়ে আসেন নি। জবাবে তখন বলা হয় যে, এটা রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক অনুসারীর ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়েছে। যেমনটি ঐতিহাসিকগণ আবু মুসলিম আল-খাওলানীর ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন। [2] আর যখন আল্লাহ রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোন অনুসারীকে অলৌকিক ঘটনার শ্রেণীভুক্ত কোন কারামত প্রদান করেন, সেটি প্রমাণ করে যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের দীন সত্য। কেননা আল্লাহ এমন নিদর্শন দ্বারা তার বলবৃদ্ধি করেছেন যা ইব্রাহীমের হাসিল হয়েছিল।
যখন তাদের সামনে বলা হয় যে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্যে তো সমুদ্র বিভাজিত হয় নি, যেভাবে মুসার জন্য বিভাজিত হয়েছিল।
তখন জবাব দেয়া হয় যে, এই উম্মতের ক্ষেত্রে সমুদ্রের ক্ষেত্রে মুসার চাইতেও বড় ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। তা হচ্ছে খোদ পানির উপর দিয়েই হেটে যাওয়া। যেমনটি রয়েছে আল ‘আলা বিন আল হাদ্বরামীর ঘটনায় যখন তিনি পানির পৃষ্টে হেটে গিয়েছিলেন। [3] এটি মুসার যা হাসিল হয়েছিল তার চাইতেও বড় ঘটনা। কেননা মুসা শুকনো জমিনের উপর হেটেছিলেন। যখন তাদের সামনে ঈসার আয়াতগুলো পেশ করা হয় যেমন তিনি মৃতকে জীবিত করেছেন যা আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে ঘটে নি। তখন উত্তর দেয়া হয় যে এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসারীদের ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়েছে। যেমনটি রয়েছে সেই ব্যক্তির ঘটনায় যার গাধা পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ করলে তিনি আল্লাহর কাছে একে জীবিত করার দোয়া করেন। ফলে আল্লাহ তা’আলা একে জীবিত করে দেন। যখন তাদের সামনে বসন্ত রোগীকে সুস্থ করার ঘটনা পেশ করা হয়। তখন উত্তর দেয়া হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রে একটি ঘটনা ঘটেছিল যখন ক্বাতাদাহ বিন নো’মা উহুদের যুদ্ধে আহত হন এবং তার চোখ বের হয়ে গালে ঝুলে পড়ে। অতঃপর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসেন। নবী এই চোখকে নিজ হাতে ধরে কোটরে স্থাপন করেন। এমনকি এই জোরা দেয়া চোখ তার দুই চোখের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে। [4]
সুতরাং পূর্ববর্তী নবীদের যেসব আয়াত রয়েছে তার একই শ্রেণীর নিদর্শন নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিংবা তার উম্মতের রয়েছে। যারা বিস্তারিত জানতে চায় সে যেন ইবন কাসীরের ইতিহাস গ্রন্থ “আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ” পড়ে নেয়।
সতর্কীকরণ: আমরা বলেছি যে কারামাত হয় বলবৃদ্ধি করতে কিংবা দৃঢ়তা বাড়াতে কিংবা ব্যক্তিকে সাহায্য করতে কিংবা সত্যকে জয়ী করতে। একারণেই সাহাবীদের তুলনায় তাবেয়ীদের ক্ষেত্রে কারামত বেশি ঘটেছে। কেননা সাহাবীদের যেই পরিমাণ দৃঢ়তা, মজবুতি ও দীনের জন্য সাহায্য ছিল তার কারণে তাদের কারামতের মুখাপেক্ষিতা ছিল না। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের মাঝেই বিদ্যমান ছিলেন। কিন্তু তাবেয়ীদের অবস্থান এর চাইতে নিম্নে। একারণেই তাদের যুগে তাদের সাহায্য, দৃঢ়তা বৃদ্ধি ও তারা যে সত্যের উপর ছিলেন তার বিজয়ে বহু কারামত সংঘটিত হয়েছে। উক্তি “আল্লাহ যা তাদের হাতে যেসব খাওয়ারিকুল ‘আদাত ঘটিয়ে থাকেন”। খাওয়ারিক হচ্ছে খারিকা বা সাংঘর্ষিক এর বহুবচন। আর ‘আদাত হচ্ছে ‘আদাহ বা স্বাভাবিক এর বহুবচন। সুতরাং “খাওয়ারিকুল ‘আদাত” বা স্বাভাবিকের সাংঘর্ষিক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে যা জগতের স্বাভাবিক নিয়মের বিপরীতে ঘটে।
এই সব কারামত চারটি নির্দেশনা প্রদান করে।
প্রথমত: কারামতের মাধ্যমে আল্লাহ আযযা ওয়াজাল্লের পরিপূর্নতা ফুটে ওঠে। কেননা আল্লাহর আদেশে স্বাভাবিকের সাংঘর্ষিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: যারা বলে প্রকৃতিই মূল কর্তা তাদের বক্তব্যের মিথ্যা প্রতিপন্ন করা। কেননা প্রকৃতিই যদি কর্তা হত, তাহলে প্রকৃতির আচরণ সর্বদা একই রকম হত, কখনো ব্যত্যয় ঘটত না। যখন স্বাভাবিক এবং প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে তখন প্রমাণিত হয়েছে যে জগতের একজন নিয়ন্ত্রণকারী এবং স্রষ্টা রয়েছেন।
তৃতীয়ত: এটি অনুসৃত নবীর নিদর্শন হয় যা এইমাত্র আমরা আলোচনা করলাম।
চতুর্থত: এর মধ্যে এই ওলীর জন্য দৃঢ়তা ও কারামত (সম্মাননা) রয়েছে। উক্তি “বিভিন্ন প্রকারের জ্ঞানলাভ, কাশফ, বিভিন্ন প্রকারের ক্ষমতা ও প্রভাব” অর্থাৎ কারামত দুইভাগে ভাগ করা যায়: একভাগ যার সম্পর্কে জ্ঞান ও কাশফের (উন্মোচন) সাথে। অপরভাগের সম্পর্ক ক্ষমতা ও তাছীর-প্রভাবের সাথে। জ্ঞানের ক্ষেত্রে কথা হচ্ছে – ব্যক্তির এমন জ্ঞান লাভ হয় যা অন্যদের হয় না। কাশফের ক্ষেত্রে কথা হচ্ছে – তার জন্য এমন সব বিষয় প্রকাশমান হয় এবং তার সামনে উম্নোচিত বা কাশফ হয় যা অন্যদের জন্য হয় না। প্রথম প্রকার তথা জ্ঞানের দৃষ্টান্ত হচ্ছে যা আবু বকর সম্পর্কে উল্লেখিত আছে যে আল্লাহ তাকে তার স্ত্রীর গর্ভের সন্তান জানিয়ে দেন। আল্লাহ তাকে জানিয়ে দেন যে, এটি কন্যাসন্তান। [5]
দ্বিতীয় প্রকার তথা কাশফের দৃষ্টান্ত হচ্ছে যা আমীরুল মুমিনীন উমার বিন আল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুর ক্ষেত্রে ঘটেছিল যখন জুমার দিন মিম্বরের উপর মানুষের সামনে খুতবা দিচ্ছিলেন। এমনসময় তারা শুনতে পায় যে, উমার বলছেন – হে সারিয়্যাহ! পাহাড়! পাহাড়! তারা এই কথায় আশ্চর্য হয়ে যায়। অতঃপর এ সম্পর্কে তারা তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন যে, তার সামনে সারিয়্যাহ বিন যুনায়ম উন্মোচিত বা কাশফ হয়েছিল যিনি ইরাকে উমারের একজন সেনাপতি ছিলেন এবং কাশফ হয় যে, শত্রুরা তাকে ঘেরাও করে নিচ্ছে। তাই উমার তাকে পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করেন এবং তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন – হে সারিয়্যাহ! পাহাড়! পাহাড়! সারিয়্যাহ উমারের আওয়াজ শুনতে পান এবং পাহাড়ের দিকে সরে আসেন এবং এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা লাভ করেন! [6] এ হচ্ছে কাশফের মাধ্যমে ঘটা বিষয়ের একটি। কেননা এটি একটি বাস্তব বিষয় যদিও তা বহুদূরে ঘটছে।
আর ক্ষমতা ও প্রভাব তৈরীর দ্ররুষ্টান্ত হচ্ছে যা মারিয়ামের ক্ষেত্রে ঘটেছিল যখন তিনি খেজুরের কাণ্ড ধরে নাড়া দেয়ায় তার উপর পাকা খেজুর ঝরে পড়ে। এছাড়াও যা ঘটেছিল কিতাবের জ্ঞানধারী ব্যক্তির ক্ষেত্রে যখন তিনি সুলায়মানকে বলেছিলেন: আমি আপনাকে (বিলকিসের সিংহাসন) আপনার চোখের পলক তোলার আগেই হাজির করব। উক্তি: “যা পূর্ববর্তী উম্মতদের থেকে কাহফ ও অন্যান্য সুরায় এবং এই উম্মতের সূচনাকাল তথা সাহাবী, তাবেয়ীন থেকে উম্মতের প্রতি যুগ থেকে বর্ণিত আছে।” কারামত পূর্বের উম্মতগুলর মাঝে বিদ্যমান ছিল। এর মাঝে রয়েছে গুহায় আটক সেই ব্যক্তিদের ঘটনা যখন একটি পাথর তাদের পথ আটকে দেয়। [7] কারামত রাসুল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে বিদ্যমান ছিল যেমন উসায়দ বিন হুদ্বায়রের ঘটনায় [8] এবং কতিপয় সাহাবীর খাবার বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনায় [9] এটি তাবেয়ীনের মাঝে বিদ্যমান ছিল যেমন সিলাহ বিন উশায়মের ঘটনায় যার জন্য আল্লাহ তার ঘোড়াকে জীবিত করে দেন।
শায়খুল ইসলাম তার “আল ফুরকান” কিতাবে বলেন: “এটি একটি প্রশস্ত বিষয়। ওলীদের কারামত সম্পর্কে অন্যত্র বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। আর আমরা যা স্বচক্ষে এই যুগেই ঘটতে দেখেছি, তা সংখ্যায় প্রচুর।” উক্তি: “এটি উম্মতের মাঝে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে।” কিয়ামতের দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকার দলীল হচ্ছে সাম’ঈ (কিতাব-সুন্নাহ থেকে শ্রুত) দলীল এবং আকলী (যৌক্তিক) দলীল।
শ্রুত দলীল হচ্ছে – রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাজ্জালের ঘটনা সম্পর্কে জানিয়েছেন যে সে এক লোকদের মধ্য থেকে এক যুবককে ডেকে আনবে। সে এসে দাজ্জালকে বলবে: “তুই মিথ্যুক। বরং তুই হচ্ছিস সেই দাজ্জাল যার ব্যাপারে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সংবাদ দিয়েছিলেন”। এতে দাজ্জাল এগিয়ে তাকে তাকে হত্যা করবে এবং দুই টুকরো করে ফেলবে। অতঃপর এক টুকরোকে এক পাশে এবং অন্য টুকরো অন্য পাশে ঢিল দিলে যত দূর যায় ততদূরে নিক্ষেপ করবে এবং উভয়ের মাঝ দিয়ে হেটে যাবে। অতঃপর একে আহ্বান করবে এবং সে উজ্জ্বল হয়ে উঠে দাঁড়াবে। দাজ্জাল তাকে দাজ্জালের উপাসত্ব স্বীকার করতে আহ্বান করবে। কিন্তু সেই ব্যক্তি বলবে: “তোর ব্যাপারে আজকে যেই গভীর দৃষ্টি লাভ করেছি তা আগে কখনো লাভ হয় নি!” ফলে দাজ্জাল তাকে হত্যা করতে উদ্যত হবে, কিন্তু তাকে এর ক্ষমতা দেয়া হবে না। [10]
সুতরাং এটা অর্থাৎ দাজ্জাল কর্তৃক সেই যুবককে হত্যা করতে অক্ষম হওয়া নিঃসন্দেহে কারামত।
আর যৌক্তিক দলীল হচ্ছে – যতক্ষন কারামত ঘটার কারণ বাকী থাকবে ততক্ষন কারামত বাকী থাকবে। কারামতের কারণ হচ্ছে ওলী হওয়া এবং এটি কিয়ামত পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে।”
সমাপ্ত
তথ্যসুত্র:
1. সিফাতুস সফওয়াহ (৩/২১৭), ইবনুল মুবারকের আয যুহদ (২৯৫), তবে এই দুইটিতে তার খচ্চর হারিয়ে যাওয়ার কথা আছে, মৃত্যুর কথা নয়।
2. ইবনুল জাওযীর সিফাতুস সফওয়াহ (৪/২০৮)। তিনি বলেন: আল আসওয়াদ আল ‘আনসী আবু মুসলিম আল খাওলানীকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিল, কিন্তু আগুন তার কোন ক্ষতির করে নি। এটি খলীল আলাইহিস সালামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
3. আবু নু’আইম আল হিলয়াহ (৭/১) তে এটি সাহম বিন মিনজাব থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আমরা আল ‘আলা আল হাদ্বরামীর সাথে একটি যুদ্ধের অভিযান গেলাম। যেতে যেতে আমরা দারাইনের কাছে আসলাম। তাদের ও আমাদের মাঝে বাধা ছিল সমুদ্র। ফলে তিনি বললেন: ইয়া আলীমু! ইয়া হালীমু! ইয়া আলিয়্যু! ইয়া আযীম! আমরা আপনার দাস! আপনার রাস্তায় আপনার দুশমনদের বিরূদ্ধে লড়াই করছি। সুতরাং আমাদের জন্য তাদের কাছে পৌঁছার রাস্তা করে দিন। সুতরাং আমরা সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়লাম অথচ পানি কেবল আমাদের গোড়ালি পর্যন্ত পৌঁছল।
4. আল হাফেয ইবন হাজার এটি “আল ইসাবাহ” (৩/২১৭) তে আল বাগাভী, আবু ইয়ালা, দারাকুত্বনী ও বায়হাকীর দালায়েলুন নুবুওয়্যাহ থেকে বর্ণনা করেছেন। আল হায়সামী একে আল মাজমা’ (৮/২৯৮) এ তাবারানী ও আবু ইয়ালার সাথে সংযুক্ত করেছেন। তিনি বলেন – তাবারানীর ইসনাদে এমন একজন আছেন যাকে আমি চিনি না। আর আবু ইয়ালার ইসনাদে আছে ইয়াহইয়া বিন আব্দুল হামীদ আল হাম্মানী, তিনি দূর্বল।
5. আল লালকায়ী এটি “কারামাতুল আওলিয়া” (৬৩) তে বর্ণনা করেছেন। ইবন হাজার এটি “আল ইসাবাহ”তে নিয়ে এসেছেন (৪/২৬১)।
6. বায়হাকী এটি “দালায়েলুন নুবুওয়্যাহ”তে বর্ণনা করেছেন এবং ইবন কাসীর “আল বিদায়াহ”তে (৭/১৩১) উল্লেখ করে বলেছেন: এর সনদ উৎকৃষ্ট। আল আলবানী একে “আস সিলসিলাতুস সহীহাহ”তে (১১১০) হাসান সাব্যস্ত করেছেন।
7. গুহার অধিবাসীদের ঘটনা আল বুখারী (৩৪৬৫) ও মুসলিম (২৭৪৩) ইবন উমার রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণোনা করেছেন।
8. উসায়দ বিন হুদ্বায়রের ঘটনা আল বুখারী (৫০১৮) এবং মুসলিম (৭৯৬) এ আবু সা’য়ীদ আল খুদরীর হাদীসে বর্ণনা করেছেন। তিনি কুরআন তিলাওয়াতকালে মেঘের উপর ফেরেশতাদের দেখতে পান।
9. আল বুখারী (৬০২) এবং মুসলিম (২০৫৭) এটি আব্দুর রহমান
বিন আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহুমার হাদীসে বর্ণনা করেছেন।
10. আল বুখারী (৭১৩২) এবং মুসলিম (২৯৩৮) এটি আবু সা’য়ীদ আল খুদরী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন।
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]