স্বনির্ভরতা অর্জনে ইসলাম : একটি পর্যালোচনা – পর্ব ১

4
2473

লেখক: ড. হুসাইন আহমাদ | সম্পাদনা: ড. মো: আবদুল কাদের

পর্বঃ ১ | পর্বঃ ২

ভূমিকা

আল্লাহ তা‘আলা ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবন বিধান ও মনোনীত ধর্ম এবং মানুষকে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সম্মানিত জাতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। পৃথিবীতে মানুষকে স্বীয় প্রতিনিধিত্ব প্রদান করেছেন। সমগ্র মানবতার মাঝে মুসলিমরাই এ খেলাফতের যোগ্য। অথচ মুসলিম জাতিই বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ ও পরনির্ভরশীল জাতি হিসেবে স্বীকৃত এবং পেশাগত দিক থেকে সর্বনিন্ম পেশা ভিক্ষাবৃত্তি মুসলিম জাতির মাঝেই উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও ইসলাম এ পেশাটিকে অসহায়ত্বে সর্বশেষ পর্যায়ে সর্বনিন্ম বৈধ পেশা বলেছে। বাস্তবতায় ইসলাম পরনির্ভরশীলতা ও ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করেছে। পক্ষান্তরে স্বনির্ভরতা অর্জনে উৎসাহিত করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবতাকে হীনতম অবস্থা থেকে সম্মানজনক অবস্থায় সমাসীন করার লক্ষ্যে ভিক্ষুকের হাতকে কর্মের হাতে পরিণত করার বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

বহুল প্রসিদ্ধ ঘটনা ভিক্ষুকের শেষ সম্বল কম্বল বিক্রয় করে কুড়াল ক্রয় করে দিয়ে স্বনির্ভরতার দীক্ষা প্রদান করেছেন। বস্তুত পবিত্র কুরআন ও হাদীস শরীফে স্বাবলম্বীতা ও স্বনির্ভরতা অর্জনের যথার্থ দিক নির্দেশনা রয়েছে। মুসলিম জাতিকে হীনমানসিকতা ও দুর্দশা থেকে মুক্তির নিমিত্তে এ বিষয়ে জ্ঞার্নাজন বিশেষ প্রয়োজন। এ লক্ষে ‘‘স্বনির্ভরতা অর্জনে ইসলাম : একটি পর্যালোচনা’’ শীর্ষক প্রবন্ধের অবতারণা। যখন বিশ্ব মানবতা বিরাজমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দুর্বহচাপে নির্যাতিত নিষ্পেষিত শোষিত ও বঞ্চিত। কেননা মানব রচিত অর্থব্যবস্থা মানব জাতির অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে সর্ম্পূনরূপে ব্যথ।

শুধু তাই নয়, যে অর্থব্যবস্থা বর্তমান বিভিন্ন দেশে কার্যকর রয়েছে, তা পুঁজিবাদ হউক বা সমাজতন্ত্র, মানব জীবনে নিত্য নতুন জটিল সমস্যা ও অর্থনেতিক ব্যাধি সৃষ্টি করছে। যা সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে নির্মম কষ্টদায়ক দারিদ্র্য ও দুঃসহ অভাব অনটনের গভীরতম পংকে। এ অর্থ ব্যবস্থায় নির্বিশেষে সমস্ত মানুষকে পেট ভরে খাবার, লজ্জা ঢাকার বস্ত্র ও রৌদ্র বৃষ্টি হতে রক্ষাকারী আশ্রয়ের ব্যবস্থাকরে দিতে সম্পূর্ণ অক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছে। ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত পরনির্ভর অসহায় হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় ‘‘স্বনির্ভরতা অর্জনে ইসলাম: একটি পর্যালোচনা’’ শীর্ষক প্রবন্ধ সময়োপযোগী ও যথার্থ নির্বাচন। এ প্রবন্ধ দুদর্শাগ্রস্ত নিঃস্ব মানুষকে স্বাবলম্বী হতে সহায়তা করবে ইনশা আল্লাহ।

পরনির্ভরশীলতা বিশ্বমানবতার জন্য অভিশাপ। এটা মানবতাকে পশুত্বের পর্যায়ে নামিয়ে নিতে পারে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন;দারিদ্রতা মানুষকে কাফির বানিয়ে দিতে পারে। এ জন্য প্রায় সবসময় আল্লাহর নিকট এ বলে প্রার্থনা করতেন, ‘‘ হে আল্লাহ তুমি আমার খাদ্যে বরকত দাও, আর আমাদের খাদ্যের মাঝে তুমি ব্যবধান সৃষ্টি করো না। কেননা যথারীতি খাদ্য না পেলে আমরা নামায রোযা করতে পারব না। আমাদের মহান রব নির্দেশিত কর্তব্য পালন করাও আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না[1]

পরনির্ভরশীলতা হল রক্ত শূন্যতা বিশেষ। অর্থ সম্পদ মানুষের জন্য সে কাজ করে যা রক্ত করে মানুষের দেহের জন্য। রক্ত মানুষের দেহ ও জীবনের স্থিতির নিয়ামক। রক্ত স্বল্পতা দেখা দিলে মানুষের দেহে নানা দুরারোগ্য ব্যাধির লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়। অনুরূপ সম্পদ না থাকলে মানুষের জীবনও অচল হয়ে পড়ে অনিবার্যভাবে।[2] তা যেমন ব্যক্তি জীবনে বিপর্যয় সুষ্টি করে তেমনি করে সামষ্টিক জীবনে। কারণ মানুষের আর্থিক প্রয়োজন দেখা দেয় জন্ম মুহুর্ত থেকেই। অর্থ সম্পদহীন ব্যক্তির যেমন কোন শক্তি মান-মর্যাদা থাকে না তেমনি পরনির্ভরলশীল জাতিও বিশ্ব জাতি সমূহের সামনে সম্মান সস্ত্রম থেকে হয় বঞ্চিত। এ বঞ্চনা ও অবমাননা হতে মুক্তির লক্ষে ইসলামের রয়েছে সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রেখে গেছেন বিশ্ববাসীর সামনে এক উজ্জ্বল শিক্ষা ও আর্দশ। নিন্মে স্বর্নিভরতা অর্জনে ইসলামের দিক নির্দেশনা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

স্বনির্ভরতা অর্জনে মালিকানার ধারণার পরিবর্তন সাধন

সম্পদের উপর একচ্ছত্র মালিকানা মানুষের ভেতর সেচ্ছাচারিতা ও লাগামহীনতার জন্ম দেয়। এ সেচ্ছাচারী মানসিকতাই হচ্ছে শোষণের মূল, যা সমাজের একাংশকে পরনির্ভরশীল করে দেয়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পদের উপর মানুষের নিরঙ্কুশ মালিকানার ধারণা রহিত করে শুরুতেই শোষণবাদী মানসিকতার মুলোৎপাটন করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি দু’টি যুগান্তকারী মূলনীতি আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে জানিয়ে দেন। প্রথমতঃ সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা কেবলমাত্র আল্লাহর। সৃষ্টি জগতের কোন বস্ত্ত তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন মানুষ তার আসল মালিক নয়।  আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন, “আকাশ মণ্ডলী ও ভূমণ্ডলের সার্বভৌমত্ব আল্লারই তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন।[3]

আরও এরশাদ করেন: “আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে সমস্ত আল্লাহরই।[4]

দ্বিতীয়তঃ মালিকানার ব্যাপারে মানুষ আল্লাহর বিধান পুরাপুরি মেনে চলবে এবং আল্লাহর ইচ্ছার বিপরীতে সে একটি কর্পদকও আয় ব্যয় করবে না। আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেনঃ “তিনিই আল্লাহ যিনি আকাশ মণ্ডলী ও ভূমণ্ডল সৃষ্টি করেছেন। যিনি আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে তদ্দারা জীবিকার জন্য ফল-মুল উৎপাদন করেন। নৌযানকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তাঁর বিধানে তা সমুদ্রে চলাফেরা করে এবং নদ-নদীকে তোমাদের সেবায় নিয়োজিত করেছেন।[5]

আরও এরশাদ হচেছঃ “তিনি তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন আকাশমণ্ডলী ও ভূমণ্ডলীর সমস্ত কিছু নিজ অনুগ্রহে, চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে তো রয়েছে নির্দশন।[6]

অতএব আকাশমণ্ডলী ও ভূমণ্ডলের সমস্ত কল্যাণ লাভ করার ও ভোগ ব্যবহারে সমস্ত মানুষ অভিন্ন ও সমান অধিকার সম্পন্ন। কেননা আল্লাহ তা‘আলা এসব কিছুকে সকল মানুষের আয়ত্তাধীন হওয়ার জন্য নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছেন। [7] এতে বিশেষ কোন ব্যক্তি বংশ বা শ্রেণী বা বর্ণের লোকদের সম্বোধন করা হয়নি। এ গুলোর উপর কারো একক কর্তৃত্বের অধিকার দেয় হয়নি। অতএব যে ব্যক্তি সম্পদ অর্জনে চেষ্টা করবে সম্পদ তার অধীনে যাবে। সুতারং নিজেকে প্রচেষ্টার মাধ্যমে স্বর্নিভরতা অর্জন করতে হবে।

জীবিকা অর্জনে উদ্বুদ্ধকরণ

সম্মানজনক ও আত্মতৃপ্তি মূলক জীবিকার জন্য স্বহস্তে উপার্জিত সম্পদের বিকল্প নেই। তাই ইসলাম জীবিকা অর্জনের লক্ষ্যে কর্মে উৎসাহিত করেছে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সব সময় কর্ম ব্যস্ত থাকতেন। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ)দেরকে কর্মে উৎসাহ প্রদান করতেন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে শ্রমের মাধ্যমে জীবিকা অর্জনে অভ্যস্ত ছিলেন। এমনকি কাজ করার কারণে তাঁর হাতে ফোস্কা পড়ে যেত। সে হাত দেখিয়ে তিনি বলতেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল এরূপ শ্রমাহত হাত খুবই পছন্দ করেন ও ভালবাসেন।রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্মের প্রতি গুরুত্বারোপ করে এরশাদ করেন।

হালাল জীবিকা উর্পাজন করা সর্বাপেক্ষা বড় কর্তব্য। [8]

তিনি আরও এরশাদ করেনঃ স্বহস্তে উর্পাজিত খাদ্য অপেক্ষা অধিক উত্তম খাদ্য আর কিছু নেই। [9]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ করেন: ইবাদতের সত্তরটি অংশ রয়েছে তম্মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে হালাল জীবিকা সন্ধান। [10]

রাসুল আরও এরশাদ করেন: সাহাবীগণ একদা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞাসা করলেন কোন প্রকারের উপার্জন উত্তম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ব্যক্তির নিজ হাতে কাজের বিনিময় বা সুষ্ট ব্যবসায় লব্ধ মুনাফা। [11]

শ্রম নিয়োগে উৎসাহ দিয়ে এরশাদ করেনঃ তোমাদের কেউ রশি নিয়ে গিয়ে জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে স্বীয় পিঠের উপর বহন করে নিয়ে আসল আল্লাহ তাকে সে ভিক্ষাবৃত্তিহতে রক্ষা করবেন যাতে কিছু পাওয়া না পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। [12]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও এরশাদ করেন: ফজরের নামাজ আদায় করার পর জীবিকা উপার্জনে লিপ্ত না হয়ে ঘুমিয়ে থেকো না। [13]

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে ব্যবসা করতেন ও বকরী চরাতেন। বস্ত্তত শুধু মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নন হযরত আদম (আঃ), হযরত দাউদ (আঃ), হযরত নূহ (আঃ) সহ সকল নবী রসুলই কাজ করেছেন। [14] রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অলস বসে না থেকে পরিশ্রমের মাধ্যমে স্বনির্ভরতা অর্জনের বাস্তব দীক্ষা প্রদান করেছেন।

ব্যবসায় উৎসাহিতকরণ

স্বাবলম্বীতা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো ব্যবসা বাণিজ্য। পবিত্র কুরআনে ব্যবসার বৈধতা ঘোষণা করা হয়েছে। এরশাদ হচ্ছে, “আল্লাহ বেচাকেনাকে হালাল করেছেন।”  [সূরা আল-বাকারাহ: ২৭৫]

পবিত্র কুরআন শুধু বৈধতাই ঘোষণা করেনি বরং ব্যবসার প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করেছে। এরশাদ হচ্ছেঃ “সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে ও আল্লাহকে অধিক স্বরণ করবে, যাতে তোমরা সফল কাম হও।[15]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে একে অন্যের সম্পদ গ্রাস করো না, কিন্তু তোমাদের পরস্পর রাজী হয়ে ব্যবসা করা বৈধ।[16]

মহানবী নিজে ব্যবসা করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার কথাও জানা যায়। তিনি একবার খাদিজা (রাঃ) এর পণ্য সামগ্রী সমেত সিরিয়া যান এবং প্রায় দ্বিগুণ মুনাফা অর্জন করেন। ব্যবসার মাধ্যমে জীবিকার্জনে তিনি প্রচুর উৎসাহব্যঞ্জক বাণী প্রদান করেছেন। তিনি বলেন, সত্যবাদী ন্যায়পন্থী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ী আম্বিয়া, সিদ্দীকীন ও শুহাদা প্রমুখ মহান ব্যক্তির সমান মর্যাদায় অভিষিক্ত হবেন। [17]

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরও বলেন, রুজীর দশভাগের নয় ভাগই রয়েছে ব্যবসা বাণিজ্যের মধ্যে। [18]

সুতারং বলা যায় স্বনির্ভরতা অর্জনে ব্যবসা বাণিজ্যের সুদূর প্রসারী ভূমিকা রয়েছে ।

ধন-সম্পদের সুষম আবর্তন ব্যবস্থা

অর্থনেতিক ভারসাম্যহীনতার কারণ সমাজের গুটিকতক লোকের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত থাকা। এর ফলে ধন-সম্পদের আবর্তন বদ্ধ হয়ে যায় এবং ধন-সম্পদ বন্টনও বিস্তারণে সামঞ্জস্য রক্ষিত হয় না। [19] যদ্দরুন পুঁজিপতি শ্রেণী আরও ধনবান এবং দারিদ্র শ্রেণী নিঃস্ব ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ে।(সঃ)

এ অবস্থার অবসান কল্পে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সমাজের সর্বস্তরের লোকের মাঝে সম্পদের সুষম আবর্তনের ব্যবস্থা করনে। [20] আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন: “যারা স্বর্ণ রোপ্য পুঞ্জিভূত করে রাখে আর তা আল্লাহর পথে ব্যয় করেনা  তাদেরকে কঠোর শাস্তির সুসংবাদ দাও।[21]

আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন: “তোমাদের মাঝে যারা বিত্তবান কেবল তাদের মাঝেই যেন সম্পদ আবর্তন না করে।[22] [সূরা হাশর]

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পদের সুষম আর্বতনের জন্য কার্যকর সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। তিনি এ জন্য যাকাত, ফিতরা, উশর, মিরাসী আ’ঈন, দান, করজে হাসান, হিবা ও ওসিয়ত ইত্যাদি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ফলে ভারসাম্য অর্থব্যবস্থা প্রর্বতিত হয়।

খাস ও পতিত জমি আবাদের ব্যবস্থা

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাস ও পতিত জমি আবাদের পদক্ষেপ স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি  পদক্ষেপ। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, যখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় পৌঁছেন তখন তিনি সেখানকার যে সকল জমিতে পানি পৌঁচাত না এবং পতিত পড়ে থাকত সেগুলো নিজ ইচ্ছামত মুসলমানদের মাঝে বন্টর করেন দেন। [23] ভূমিতেই মহান আল্লাহ মানুষের প্রাচুর্যের ব্যবস্থা রেখেছেন।  আল্লাহ তা‘আলা বলেন: সে মহান সত্ত্বা আল্লাহ জমিনকে তোমাদের জন্য নরম সমতল অনুগত বানিয়ে দিয়েছেন। অতএব তোমরা সে জমিনের সর্বদিক ও পরতে পরতে পৌঁছাতে চেষ্টা কর, আর সেখানে থেকে পাওয়া আল্লাহর রিযিক তোমরা ভক্ষণ কর। আর শেষ পর্যন্ত তাঁর কাছেই তোমাদের উত্থান ঘটবে| [24] [সূরা মুলক:১৫]

এ জন্যই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পতিত ভূমি আবাদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং এ ব্যাপারে সবাইকে উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন, যার জমি রয়েছে সে তা হয় নিজে চাষ করবে, অন্যথায় তার কোন ভাইয়ের দ্বারা চাষ করাবে অথবা তাকে চাষ করতে দেবে। [25]

মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পতিত জমি কেবলমাত্র চাষ করতেই বলেননি বরং উৎসাহ দেয়ার জন্য পতিত জমিতে চাষকারীর মালিকানারও স্বীকৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেনঃযে লোক পোড়া ও অনাবদী জমি আবাদ ও চাষযোগ্য করে নেবে সে তার মালিক হবে। [26]

পতিত জমি আবাদে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, তা নিশ্চিত করার জন্য তিনি বলেন, ‘‘জমি আবাদ না করলে তিন বছর পর তার কোন অধিকার থাকবে না। [27] তিনি আরও বলেন, আর যে শুধু তার সীমানা নির্ধারণ করে রেখেছে অথচ তার চাষ করেনি, তিন বছর পর তাতে তার কোন অধিকার নেই। [28]

ভিক্ষাবৃত্তি উচ্ছেদ

পরনির্ভরশীলতার সর্বশেষ পর্যায় হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ করে স্বনির্ভরতা অর্জনের বাস্তব শিক্ষা প্রদান করেছেন। নিন্মের ঘটনায় যার বাস্তব প্রমাণ পাওয়া যায়। একদিন এক ব্যক্তি তাঁর কাছে কিছু সাহায্য চেয়েছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করে জেনে নেন যে, তার কি সম্পদ আছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সম্পদ অর্থাৎ একটা পেয়ালা ও একটা কম্বল আনতে বললেন, ঐ গুলো নিলাম করে দিয়ে ২ দিরহাম সংগ্রহ করলেন। ১ দিরহাম দিয়ে ঐ ব্যক্তির মাধ্যমে একটা কুঠার ক্রয় করে আনালেন। ঐ কুঠার তিনি নিজে হাতল লাগানোর পর তার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘যাও জঙ্গলে গিয়ে কাঠ কাট এবং ১৫দিন তোমাকে যেন আর না দেখি’’ এভাবে তিনি শ্রমের মাধ্যমে স্বনির্ভর হতে বলেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভিক্ষায় অর্জিত সম্পদকে জাহান্নামের ‘উত্তপ্ত পাথর’ বলেছেন:যে ব্যাক্তি অভাব ব্যতীত ভিক্ষা করে সে যেন (জাহান্নামের)  পাথর ভক্ষন করে। [29]

তিনি আরও বলেন:তোমাদের মাঝে যে ভিক্ষা করে সে যখন আল্লাহর সামনে যাবে তখন তার চেহারায় এক টুকরা গোশতও থাকবে না। [30]

মহানবী এমনিভাবে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও নিরুৎসাহিত করণেরমাধ্যমে ভিক্ষাবৃত্তি উচ্ছেদ করেন।

সুদমুক্ত ঋণপ্রদন

দরিদ্র ও পরনির্ভরশীল মানুষকে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য করজে হাসানাহ্ বা সুদ মুক্ত ঋণ দান একটি অতি উত্তম পন্থা। এ কারণে ইসলামী শরিয়ত দরিদ্র অসহায়, নিঃস্ব, অভাবী মানুষকে নিঃস্বার্থভাবে ঋণ প্রদানকে সম্পদশালী ও ধনীব্যক্তিদের উপর ওয়াজিব ঘোষণা করেছে। যাতে পারস্পপারিক সহযোগিতা প্রীতি, ভালবাসা বৃদ্ধিপায় এবং দায়িত্বানুভূতি বিকশিত হয়। যদিও বিরাজমান পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা সুদমুক্ত ঋণদানকে বোকামী মনে করে। আল্লাহ তাওয়ালা সমাজের ধনশালীদের ঋণদানে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ তা‘আল বলেন: “তোমরা আল্লাহকে করজে হাসানাহ্ (উত্তম ঋণ) দাও।[31]

অন্য আয়াতে অভাবী নিঃস্ব পীড়িতকে ঋণদান প্রকারান্তরে আল্লাহকে ঋণ প্রদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে: “যে আল্লাহকে উত্তমরূপে ঋণ (সুদমুক্ত) প্রদান করবে, আল্লাহ তার সেই দানকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে (কিয়ামতের দিন পুরুস্কার হিসেবে) দিবেন।[32]

বাস্তবতায় বর্তমানে সারা পৃথিবীর কোথাও ইসলামের এ সুমহান শিক্ষার অনুসরণ করা হচ্ছে না। বিধায় সুদের রাজত্ব সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে গোটা বিশ্বব্যাপী, দেশ, অঞ্চল, প্রতি জনপদে। অর্থনীতির চাকা সুদ ছাড়া ঘুরছে না। ফলে ধনী আরো ধনী হচ্ছে আর অভাবী দরিদ্র জনগোষ্ঠী দারিদ্রের চুড়ান্ত পর্যায় অসহায় ও পরনির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। ধনী দরিদ্রের ব্যবধান সামাজিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। লক্ষ- কোটি বনী আদম মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হচ্ছে। অথচ করজে হাসানাহ্ প্রচলিত থাকলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী স্বনির্ভরতা অর্জনের সুযোগ পেত। এতে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান দুর হয়ে সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা হত।

পর্বঃ ১ | পর্বঃ ২


[1]. আহমাদ শালাবী, আল-হুকুমাতুল ইসলামিয়্যাহ, দারুল আরব, কায়রো, খৃ. ১৯৯১, পৃ. ৫৩০
[2]. মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, আল-কুরআনে রাষ্ট্র ও সরকার, খায়রুন প্রকাশনী, ঢাকা, খৃ. ১৯৯৫, পৃ.৩১৬
[3]. আল-কুরআন ৪২: ৪৯
[4]. আল-কুরআন ২: ২৮৪
[5]. আল-কুরআন ১৪: ৩২
[6]. আল-কুরআন ৪৫: ১৩
[7]. Professor Raihan Sharif, Islamic Economics : Principles and Applications, IFB. Dhaka, 1985, P. 226
[8]. খৃ. ১৯৮০, সংস্ক. ২ পৃ.-১২ আবু বকর আহমাদ ইবনু হুসাইন আল-বায়হাকী, আস-সুনানুল কুবরা, দারুল মা’আরিফ, বৈরুত, হি. ১৪০৬ শু’আবুল ইমান।
[9]. সুনানু নাসাঈ, কিতাবুল বুয়ু, হাদীস নং ৪৩৭৫
[10]. আহমাদ শালাবী প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৩৫
[11]. মুসনাদু আহমাদ, হাদীস নং ৫২৭৬
[12]. সাহীহুল বুখারী, কিতাবুয যাকাত, হাদীস নং ১৩৭৭
[13]. মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, খৃ. ১৯৮৯ সংস্ক, ৪, পৃ.-২৬
[14]. Farid Uddin Mosuad, ibid. চ. ৪৪,৪৫
[15]. আল- কুরআন ৬২: ১০
[16]. আল- কুরআন ৪: ২৯
[17]. সুনানুত তিরমিযী,, কিতাবুল বুয়ু, হাদীস নং ১১৩০
[18]. আলা উদ্দিন আল-মুত্তাকী, কানযুল উম্মাল, মুআস্সাতুর রিসালাহ, বৈরুত খৃ. ১৯৮৫, খ. ৪, পৃ.- ১২৬
[19]. সাইয়্যেদ  আবুল আলা মা’ওদুদী, ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ, অনু.মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা খৃ. ১৯৭৬ ইং,  ৮৩-৮৪
[20]. আবুল খালেক, বিশ্বনবী (সঃ) এর কর্মসূচীতে অর্থনীতির রূপ, অগ্রপথিক, ইফাবা, ঢাকা, এপ্রিল, খৃ. ১৯৯৫
[21]. আল-কুরআন ৯: ৩৪
[22]. আল- কুরআন ৫৯: ৭
[23]. গাজী শামছুর রহমান, রাসুল (সঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের যমানায় কৃষক, অগ্রপথিক, ইফাবা, ঢাকা, জানুয়ারী-মার্চ, খৃ. ১৯৯৮, পৃ.- ৪৩
[24]. আল-কুরআন ৬৭: ১৫
[25]. সহীহ লি মুসলিম, কিতাবুল বুয়ু, হাদীস নং ১৮৬৫
[26]. সুনানুত তিরমিযী, কতিাবুল আহকাম, হাদীস নং ১৩০০
[27]. ড. মায়েজুর রহমান, খাদ্য সমস্যাও ইসলাম, ইফাবা, ঢাকা, খৃ. ১৯৮৭,  পৃ.- ৩২
[28]. আবু ইউছুফ, কিতাবুল খারাজ, দারুল কুরআন ওয়া উলুমুল ইসলামিয়া, পাকিস্তান, খৃ. ১৯৮৬, পৃ.- ৬৫
[29]. মুসনাদ আহমাদ হাদীস নং ১৬৮৫।
[30]. সহীহুল বুখারী কিতাবুল যাকাত হাদীস নং ১৩৮১।.
[31]. আল-কুরআন ৭৩: ২০।
[32]. আল-কুরআন ০২: ২৪৫।


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

4 COMMENTS

  1. মাশাল্লাহ অনেক ভাল লিখা । আমাদের দেশের অর্থ নিতিবিদ দের পরা উচিত।

  2. SELF HELP IS THE BEST HELP.BEGGARY IS NOT PERMITTED IN ISLAM.BEGGERY MAKES US IDLE.THIS ARTICLE TELLS IT FINELY.

আপনার মন্তব্য লিখুন