লেখকঃ ড. আয়িদ আল করনী | অনুবাদঃ ডা. হাফেজ মাওলানা মােহাম্মদ নূর হােছাইন
আমাদের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) সকল মানুষের নিকট জান্নাতী পয়গাম নিয়ে আগমন করেছেন। তিনি পার্থিব আকাক্ষা দ্বারা পরিচালিত হতেন না। ব্যয় করার জন্য তার কোন ধন-ভাণ্ডার ছিল না। খাবার জন্য চমৎকার কোন (খেজুর) বাগান ছিল না; আর বসবাস করার জন্য কোন সুন্দর প্রাসাদ ও ছিল।
এতসব সত্ত্বেও তার প্রিয় অনুসারীরা তার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার দিয়েছেন, অবিচল থেকেছেন। সমস্যা-সঙ্কুল এক কঠিন জীবন সহ্য করেছেন। তারা ছিলেন গুটি কয়েকজন ও দুর্বল, তাদের প্রতিবেশীদের দ্বারা সমূলে বিনাশ হয়ে যাবার ভয়ে ভীত, তবুও তারা নবী করীম (সাঃ)-কে পুরােপুরি ভালােবাসতেন।
তাদেরকে গিরিপথে বন্দি করা হয়েছিল। আর সে সময়ে তাদের নিকট অল্প। খাদ্য ছিল বা কোন খাদ্য ছিল না। তাদের সুখ্যাতি আক্রান্ত হয়েছিল; তাদের নিজেদের আত্মীয়রাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিল, তবুও নবী করীম (সাঃ)-এর প্রতি তাদের ভালােবাসা ছিল নিষ্কলুষ।
তাদের কাউকে মরুভূমির তপ্ত বালুর উপর ফেলে হেঁচড়ানাে হয়েছিল, কিছু। লােককে বন্দী করা হয়েছিল আর অন্যরা নতুন নতুন ও অদ্ভুত অদ্ভুত শাস্তির শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। এসব শাস্তিই তাদেরকে কাফেররা দিয়েছিল। তারা ঐসব শাস্তি সহ্য করতে বাধ্য হয়েও তাঁকে সর্বান্তঃকরণে মন খুলে ভালােবেসেছিলেন।
তারা ঘর-বাড়ি, স্বদেশ, পরিবার ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তাঁরা তাদের বাল্যকালের খেলার মাঠ ও বসত বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। এসব ভােগান্তি সত্ত্বেও তাঁকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ভালােবেসেছেন তারা। তাঁর (নবুয়তের) সংবাদের কারণেই ঈমানদারগণ অগ্নিপরীক্ষার শিকার হয়েছিলেন। তাঁদের পদতলের ভূমি প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠেছিল। তবুও তাঁর প্রতি তাদের ভালােবাসা অনবরত বাড়ছিলই।
তাদের যৌবনের বসন্ত ঋতুর শিরােপরি সদা বিপজ্জনকভাবে তরবারি ঝুলন্ত ছিল। তারা শুধুমাত্র তাঁকে নিঃশর্তভাবে ভালােবাসত বলেই এমন মৃদুভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে (যুদ্ধের ময়দানে) মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন, যেন তারা প্রমােদ ভ্রমণে বা অবসর যাপনে ছিলেন।
একজন সাহাবীকে নবী করীম (সাঃ)-এর নবুওয়াতের সংবাদ বিদেশে এক রাজার নিকট নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হলাে। অথচ তিনি জানতেন যে, এটা এমন এক কাজ যা থেকে তিনি ফিরে আসবেন না। আরেকজন সাহাবীকে এক কাজে পাঠানাে হলাে। তিনি জানতেন যে, এটা তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে, তবুও তিনি সন্তুষ্টচিত্তে সে কাজে গেলেন। কারণ, তিনি নবী করীম (সাঃ) কে নিরঙ্কুশ ভালােবাসতেন।
কিন্তু কেন তারা তাকে ভালবাসতেন এবং কেন তাঁরা তাঁর নবুওয়তে এত সন্তুষ্ট ও তাঁর আদর্শে এত পরিতুষ্ট ছিলেন? কেন তারা তাকে অনুসরণ করাতে যে দুঃখ-কষ্ট ও ভােগান্তি হয়েছে তা ভুলে গিয়েছেন?
এক কথায় বা সহজভাবে এর কারণ বলতে হয় যে, তিনি বদান্যতার ও ধার্মিকতার সর্বোচ্চ শিখর অধিকার করেছিলেন। তারা তার মাঝে সত্য ও বিশুদ্ধতার সব লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন। যারা মহত্তর জিনিসের সন্ধান কোমলতার দ্বারা মানুষের মনের হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা ও তিক্ততা শীতল করে দিয়েছিলেন। সত্য বাণী দিয়ে তিনি তাদের অন্তরকে শান্ত করে দিয়েছিলেন ও তাঁর রিসালাত দ্বারা তিনি তাঁদের অন্তরসমূহকে শান্তিতে ভরে নিয়েছিলেন।
তিনি তাঁদের অন্তরে এত শান্তি ঢেলে দিয়েছিলেন যে, তাঁরা তাঁর পাশে থাকার কারণে যে যাতনা ভােগ করেছিলেন, তা তাঁরা তুচ্ছ মনে করেছিলেন। তিনি তাঁদের অন্তরে এমন ঈমান বা বিশ্বাস সঞ্চার করেছিলেন যে, তারা যে আঘাত ও প্রতিকূল অবস্থা সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা তারা ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি তাঁদের ভিতরকে হিদায়াতের আলাে দ্বারা ঘষেমেঝে চকচকে করে দিয়েছিলেন ও তাদের চক্ষুসমূহকে তার নূরে নূরান্বিত বা তার আলােতে আলােকিত করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের থেকে মূখতার বােঝা, মূর্তিপূজার বিকৃত রুচি এবং বহু-ঈশ্বরবাদের কুফল দূর করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন এবং তাঁদের অন্তরে ঈমানের পানি ঢেলে দিয়েছেন। এভাবে তাদের দেহমন প্রশান্ত হয়েছিল ও তাঁদের আত্মা শান্তি পেয়েছিল।
তাঁরা নবী করীম (সাঃ)-এর সাথে থেকে জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করেছেন এবং তাঁরা তাঁর সাহচার্যে পুলক বােধ করেছিলেন বা আনন্দ পেয়েছিলেন। তাঁরা তাঁর পাশে থেকে সুখ এবং তাঁর অনুসরণে নিরাপত্তা, মুক্তি ও আত্মসমৃদ্ধি পেয়েছিলেন।
মহান আল্লাহ বলেন: “এবং আমি আপনাকে (হে মুহাম্মদ) সারা বিশ্বের জন্য রহমত বা করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছি।” [২১-সূরা : আল আম্বিয়া : আয়াত-১০৭]
“এবং অবশ্যই তুমি (মানবজাতিকে) সরল পথ দেখাচ্ছ।” [৪২-সূরা আশ শূরা : আয়াত-৫২]
“এবং তিনি (গ্রন্থকার ‘তিনি বলতে মুহাম্মদ (সাঃ) কে বুঝিয়েছেন; কিন্তু কুরআনের ঐ আয়াত দ্বারা তিনি বলতে স্পষ্টরূপে ‘আল্লাহকেই’ বুঝা যায়। -অনুবাদক।) স্বেচ্ছায় তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলাের দিকে (নিয়ে যান)।” [৫-সূরা মায়িদা : আয়াত-১৬]
“তিনিই নিরক্ষরদের মাঝ থেকে তাদের মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করেন, তাদেরকে (কুফুরি ও শিরক থেকে) পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন এবং নিশ্চয় তারা পূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিল।” [৬২-সূরা আল জুমুআ : আয়াত-২]
“তাদের উপরে যে বােঝা ও শৃঙ্খল ছিল, তিনি তাদের থেকে তা সরিয়ে দেন।” [৭-সূরা আল আরাফ : আয়াত-১৫৭]
“যখন তিনি তােমাদেরকে এমন বিষয়ের দিকে আহ্বান করেন যা তােমাদের প্রাণ সঞ্চার করে তখন তােমরা আল্লাহ ও রাসূলের আহ্বান সাড়া দিও।” [৮-সূরা আনফাল : আয়াত-২৪]
তাঁরা তাঁদের নেতার সাথে থেকে সত্যিই সুখী ছিলেন এবং তাঁরা যথার্থই সুখী হওয়ার যােগ্য ছিলেন।
হে আল্লাহ! বিপথ গমনের শৃঙ্খল হতে আত্মার মুক্তিদাতা ও মিথ্যার অভিশাপ থেকে আত্মার উদ্ধারকারী মুহাম্মাদের উপর করুণা ও শান্তি বর্ষণ করুন এবং তার মহান সাহাবীদের সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার প্রতিদানস্বরূপ তাঁদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।
উৎসঃ লা তাহযান [হতাশ হবেন না], ক্রমিক নংঃ ৪৪, পৃষ্ঠা: ১০৯ – ১১২
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]