লেখক: ড. মুহাম্মদ ইবনে আবদুর রহমান আরিফী | অনুবাদক: রাশেদুল আলম
সে কি তাকে আগুনে নিক্ষেপ করবে?’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের এই প্রশ্ন করেছেন। সাহাবায়ে কেরাম রা. হাওয়াজিনের যুদ্ধের মধ্যে রয়েছেন। হাওয়াজিন গােত্রের সাথে মুসলমানদের যুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে মুসলমানদের বিজয় হয়। এই মাত্র যুদ্ধ শেষ হয়েছে, এদিক ওদিক যুদ্ধে নিহত মানুষের লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। হাওয়াজিন গােত্রের নারী ও শিশুদের বন্দি করা হয়েছে। বন্দিদের সাথে কীধরনের আচরণ করা হবে সে বিষয়টা এখানাে সিদ্ধান্ত হয়নি। বন্দি নারী ও শিশুদের মাঝে একটি মহিলা পাগলের মত দৌড়াচ্ছে এবং প্রতিটি শিশুর চেহারার দিকে তাকাচ্ছে।
যেখান থেকেই কোনাে শিশুর কান্নার আওয়ায আসছে, সেদিকেই সে দৌড়ে যাচ্ছে, কোনাে মহিলার কোলে কোনাে শিশুকে দেখলে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে তার চেহারা দেখে নিচ্ছে। একবার এক মহিলার কোলে একটি শিশুকে দেখে দৌড়ে তার কাছে যায় এবং তার কাছ থেকে শিশুটিকে নিয়ে ভাল করে দেখে আবার তার কাছে ফিরিয়ে দেয়। যে কেউ মহিলাটির এই অবস্থা দেখলে বুঝতে পারবে যে, মহিলা কোলের শিশুকে খুঁজে পাচ্ছে না, সে তাকে দুধ খাওয়ানাের জন্যে অস্থির। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাটির এই অবস্থা দেখছিলেন।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর মহিলাটি বাচ্চাটিকে পেল, সে তাকে কাছে পেয়েই দুই হাত দিয়ে বিছুক্ষণ বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলাে, অতঃপর তাকে খুব আগ্রহ নিয়ে বুকের দুধ পান করালাে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সন্তানের প্রতি মায়ের এই দয়া, দরদ ও মমতা দেখে সাহাবায়ে কেরাম রা. কে প্রশ্ন করে বললেন, এই মহিলাটি কি তার এই সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করতে পারবে? সাহাবায়ে কেরাম রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! সে তাকে কখনই আগুনে নিক্ষেপ করতে পারবে না। সে তাকে কীভাবে আগুনে নিক্ষেপ করবে? সে তাকে কোলে নিয়েছে, বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে তাকে দুধ পান করিয়েছে। সে তাকে অনেক ভালবাসে, সবকিছুর চেয়ে বেশি মুহাব্বত করে। সুতরাং সে তাকে কিছুতেই আগুনে নিক্ষেপ করতে পরবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সাহাবিদের উদ্দেশ্য করে বললেন: ঐ সত্তার কসম করে বলছি, নিশ্চয় এই ছেলের প্রতি এই মায়ের যতটা দয়া ও ভালবাসা রয়েছে, আল্লাহ তাআলা তার বান্দাকে তার চেয়েও বেশি ভালবাসেন ও দয়া করেন।
নিশ্চয় বন্দার প্রতি আল্লাহ তাআলা এই ছেলের প্রতি মায়ের চেয়েও বেশি দয়ালু। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের এ ধরনের বিভিন্ন বাস্তব ঘটনার উদাহরণ দিয়ে বিভিন্ন বিষয় বুঝতেন। কখনাে কখনাে বাস্তব উদাহরণ দিয়ে তাদেরকে সদকার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন, আবার কখনাে কোনাে নেক আমলের প্রতি উদ্বুদ্ধ করতেন। সুতরাং এখানে তিনি সাহাবিদেরকে বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে একথা বুঝাচ্ছেন যে, আল্লাহ তাআলা বান্দার প্রতি এই মায়ের চেয়েও বেশি দয়ালু, তাই তােমরা কখনাে তার দয়া থেকে নিরাশ হয়াে না। তিনি বলেন: ‘ঐ সত্তার কসম করে বলছি, নিশ্চয় এই ছেলের প্রতি এই মায়ের যতটা দয়া ও ভালবাসা রয়েছে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাকে তার চেয়েও বেশি ভালবাসেন ও দয়া করেন।
আর এ কারণেই সালাফদের মধ্য থেকে কেউ একজন বলেছেন, আমাকে যদি আল্লাহ তাআলা এই সুযােগ দেন যে, তুমি আল্লাহ অথবা তােমার মা এই দুই জনের যাকে দিয়ে খুশি তােমার (পরকালের) হিসাব নেওয়াতে পারাে, তাহলে আমি আল্লাহ তাআলাকেই আমার হিসেবের জন্যে বেছে নিব, কারণ তিনি আমার মায়ের চেয়েও আমার প্রতি বেশি অনুগ্রহশীল।
এ বিষয়ে অন্য একটি উদাহরণ দিচ্ছি, আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন, আমরা একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ইলাম, এমন সময় অতিশয় বৃদ্ধ এক লােক আসলাে, বয়সের ভারে যার রীরের হাড্ডিগুলাে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল, পিঠ বাঁকা হয়ে গিয়েছিল, এবং তার মাথার চুলগুলাে সব সাদা হয়ে গিয়েছিল, এই লােকটি তিন পায়ের উপর ভর করে আসলাে, অর্থাৎ তার দুই পা ও এক লাঠির উপর ভর করে হাঁটছিল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এমন এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ালাে, বয়সের ভারে যার চোখের ভ্রগুলাে ঝুলে পড়েছে। লােকটি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলল, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আপনি এমন লােকের ব্যাপারে কী বলেন, যে সব ধরনের গুনাহ করেছে; কোনাে গুনাহই ছাড়ে নাই? তার মন যা চেয়েছে সে তাই করেছে। তার অপরাধ ও গুনাহগুলাে যদি পৃথিবীর সকল মানুষকে ভাগ করে দেওয়া হয়, তাহলেও তাদের সকলকে তা ঢেকে নিবে। এই লােকটির কি তাওবার কোনাে সুযােগ আছে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন তার দিকে চোখ তুলে তাকালেন এবং বললেন, আপনি কি ইসলাম গ্রহণ করেছেন? লােকটি বলল, হাঁ। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে আপনার সকল গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে। সে বলল, আমার প্রতারণা ও আমার পাপ কাজগুলাে সবই কি ক্ষমা করা হয়েছে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ আপনার প্রতারণা ও পাপ কাজগুলাের সবই ক্ষমা করা হয়েছে। এরপর লােকটি তার লাঠির উপর ভর করে আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার বলতে বলতে চলে গেল। লােকটি অনেক দূর যাওয়া পর্যন্ত আমরা তার তাকবিরের আওয়ায শুনছিলাম।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন সুসংবাদদাতা; তিনি নিরাশকারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন নমনীয়; তিনি কঠোর বা অনমনীয় ছিলেন না। তিনি মানুষকে আল্লাহর রহমতের আশা দেখাতেন। তিনি মানুষের পথ থেকে দয়া ও আশার দরজা বন্ধ করার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন: ‘নিশ্চয় তােমরা সহজকারী হিসেবে প্রেরিত হয়েছে; কঠোরতা আরাপকারী হিসেবে নও।’
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মুয়ায ইবনে জাবাল ও আবু মুসা আশআরি রা. কে ইয়ামানে পাঠান, তখন তিনি তাদেরকে বলেন; ‘তােমরা মানুষকে সুসংবাদ দিবে, আশা দেখাবে; কখনাে উপেক্ষা করে নিরাশ করবে না, অর্থাৎ তােমরা মানুষকে সুসংবাদ দাও, তাদেরকে আল্লাহর দয়া, রহমত ও মুমিন বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালবাসার কথা বলবে। তাদেরকে নিরাশ করবে না দূরে ঠেলে দিবে না। তাদের সাথে নরম ও সহজ ব্যবহার করবে; কখনাে কঠোর ও শক্ত ব্যবহার করবে না। তাদের সাথে নরম ও দয়ার সাথে কথা বলবে; কখনাে মতানৈক্যে যাবে না। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন, হে মানুষ নিশ্চয় তােমাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী রয়েছে। অর্থাৎ এমন মানুষ রয়েছে যারা মানুষদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে, তাদেরকে ভয় দেখিয়ে দীন থেকে ফিরিয়ে রাখে। কিন্তু হাদিসে উল্লিখিত আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বলে কাকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে? তােমরা প্রথমে শুনে রাখাে যে, এখানে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী বলে কাকে উদ্দেশ্য নেওয়া হয়েছে, অতঃপর নিজেদের উপর তা যাচাই করে দেখাে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : “নিশ্চয় তােমাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী রয়েছে, সুতরাং তােমাদের যারা জনগণের দায়িত্বরত থাকবে তারা যেনাে তাদের সাথে সহজ ব্যবহার করে।
অনেক মানুষ আছে যারা লম্বা-চূড়া সালাত আদায় করে; কিন্তু লম্বা-চূড়া সালাত আদায় করেও মানুষ দীনের ব্যাপারে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী হতে পারে, দীন থেকে মানুষকে ফিরিয়ে রাখতে পারে!! ঐ ব্যক্তির ব্যাপারে তােমার কী মনে হয়, যে ঠিকমত শ্রমিকের হক আদায় করে না? সে কি আতঙ্ক সৃষ্টিকারী নয়? সে কি মানুষকে দীন থেকে ফিরিয়ে রাখছে না? যে ব্যক্তি অমুসলিমদের সামনে কুটি করে থাকে, তাদের সাথে গােস্বা মুখে কথা বলে, সে কি আতঙ্ক সৃষ্টিকারী নয়? সে কি মানুষকে দীন থেকে ফিরিয়ে রাখছে না? যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীদের সাথে ভাল ব্যবহার করে না, তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে, হােক সে প্রতিবেশী মুসলিম বা অমুসলিম, সে কি আতঙ্ক সৃষ্টিকারী নয়? সে কি মানুষকে দীন থেকে ফিরিয়ে রাখছে না? যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর সাথে খারাপ ব্যবহার করে, তাকে তার হক ঠিকমত আদায় করে না, সে কি আতঙ্ক সৃষ্টিকারী নয়? সে কি মানুষকে দীন থেকে ফিরিয়ে রাখছে না? হে ভাই! এর মাধ্যমে ইসলাম নিয়ে কথা বলার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং বিরােধী শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে। মানুষ দীনকে যত বেশি আঁকড়ে ধরবে, সে ততাে বেশি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জন করবে। আল্লাহর রহমত সুপ্রশস্ত। তবে তােমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ তাআলা যেমন দয়ালু, ঠিক তেমনিভাবে তিনি কঠোরও।
মুসা আ.-এর সময় বনি ইসরাইলের এক লােকছিলাে, যে মুসা আ.কে অনেক কষ্ট দিতাে। ফলে মুসা আ. আল্লাহ তাআলার কাছে অভিযােগ করে বলল, হে আমার প্রতিপালক! এই লােকটা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়, আমার দাওয়াতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে, সব জায়গায় সে আমাকে নিয়ে চিল্লাচিল্লি করে, আমাকে অপমান করে। হে আমার প্রতিপালক! সে আমাকে অনেক কষ্ট দেয়, সুতরাং আপনি তার থেকে প্রতিশােধ গ্রহণ করুন। তখন আল্লাহ তাআলা বললেন, হে মুসা! আমি তাকে শাস্তির ক্ষমতা তােমার হাতে দিয়ে দিলাম; তুমি যখন চাইবে আকাশকে আদেশ করবে, আকাশ তার উপর প্রস্তর-বৃষ্টি বর্ষণ করে তাকে ধ্বংস করে দিবে। অথবা যমিনকে আদেশ করবে, যমিন তাকে গিলে ফেলবে। এরপর কয়েক দিন পর রাস্তায় মুসা আ.-এর সাথে লােকটির দেখা হল আর লােকটি তাঁকে দেখেই গালাগালি শুরু করে দিল। মুসা আ. তখন রাগান্বিত হয়ে যমিনকে বললেন, হে যমিন! তুমি তাকে পাকড়াও করাে। তখন যমিন লােকটির টাখনু পর্যন্ত ভিতরে নিয়ে নিলাে। তখন লােকটি বলতে লাগলাে, হে মুসা! আমি তাওবা করছি, আমাকে রক্ষা করাে, আমাকে উদ্ধার করাে। মুসা আ. বললেন, যমিন! তাকে পাকড়াও করাে। এবার যমিন আরেকটু ফাঁকা হল এবং তার হাঁটু পর্যন্ত ভিতরে নিয়ে নিলাে। লােকটি আবার বলল, হে মুসা! আমি তাওবা করেছি আমাকে রক্ষা করাে, আমাকে উদ্ধার করাে। মুসা আ. বললেন, যমিন! তাকে পাকড়াও করাে।
এবার যমিন আরেকটু ফাঁকা হল এবং তার কোমর পর্যন্ত ভিতরে নিয়ে নিল। এরপর বুক পর্যন্ত, আর লােকটি চিৎকার করতেই ছিল, এরপর সম্পূর্ণভাবে তাকে মাটির নিচে নিয়ে গেল আর লােকটি মারা গেল। তখন আল্লাহ তাআলা মুসা আ.-এর নিকট ওহি প্রেরণ করে তাঁকে বললেন, হে মুসা! তােমার হৃদয় এতটা পাষাণ! আমার ইযযতের কসম করে বলছি, সে যদি আমার কাছে সাহায্য চাইতাে আমি তাকে সাহায্য করতাম।
আমাদের রব আল্লাহ তাআলা অনেক দয়ালু; কিন্তু তিনি শাদিদুল ইকাব তথা শাস্তি দানে কঠোরও বটে। নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুহ আ.-এর সময় তুফানে ডুবে যাওয়া এক নারী ও তার সন্তানের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সেখান থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ তাআলা মহাপ্রতাপশালী, তিনি যখন অসন্তুষ্ট হন, ক্রোধান্বিত হন।
নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নুহ আ.-এর সময় তুফানে ডুবে যাওয়া এক নারী ও তার সন্তানের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। নুহ আ. আপন প্রতিপালকের নিকট দোয়া করলেন; যেমনিভাবে কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে : ‘অতঃপর সে তার পালনকর্তাকে ডেকে বললাে, আমি অক্ষম, অতএব তুমি প্রতিবিধান করাে। তখন আমি খুলে দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারিবর্ষণের মাধ্যমে। এবং ভূমি থেকে প্রবাহিত করলাম প্রস্রবণ। অতঃপর সব পানি মিলিত হল এক পরিকল্পিত কাজে। আমি নুহকে আরােহণ করালাম এক কাষ্ঠ ও পেরেক নির্মিত জলযানে। যা চলতাে আমার দৃষ্টির সামনে। যা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিলাে এটা ছিলাে তার পক্ষ থেকে প্রতিশােধ।‘ [সুরা কামার, আয়াত : ১০-১৪ ]
এভাবেই কুরআনে কারিমে নুহ আ.-এর কওমের ডুবে যাওয়ার ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। অন্য আরেক আয়াতে তুফানটির ভয়াবহতা এভাবে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যখন জলােচ্ছাস হয়েছিলাে, তখন আমি তােমাদেরকে চলন্ত নৌযানে আরােহণ করিয়েছিলাম।‘ [সুরা হাক্কাহ, আয়াত : ১১]
জলােচ্ছাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে আপনারা সকলেই তাে জানেন। যখন জলােচ্ছ্বাস হয় তখন তা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়, গাছপালা উপড়ে ফেলে, বাড়িঘর চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়, পথের গাড়ি-ঘােড়াগুলােকে ভাসি নিয়ে যায়, চারপাশের সবকিছুকে শিশুদের খেলানার মত লণ্ডভণ্ড করে দেয়। মানুষজন কাঁদতে থাকে, চিৎকার করতে থাকে, সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে, কেউ গাছের ডালে ঝুলে থাকে, কেউ কারেন্টের খাম্বা ধরে থাকে, কেউ পাহাড়ে উঠে আর পানি তাদের সকলকেই ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা এই তুফানকেই তাগাল মা’ (জলােচ্ছ্বাস হয়েছে) দ্বারা ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যখন জলােচ্ছ্বাস হয়েছিলাে, তখন আমি তােমাদেরকে চলন্ত নৌযানে আরােহণ করিয়েছিলাম।‘ [সুরা হাক্কাহ, আয়াত : ১১]
অর্থাৎ যখন জলােচ্ছ্বাস হল তখন আমি তােমাদেরকে নৌযানে আরােহণ করিয়েছিলাম, তখন ঢেউ তাকে নিয়ে ডানে বামে কাত করছিলাে আর তােমাদের রবই তখন সেটাকে ডুবে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘যাতে এ ঘটনা তােমাদের জন্যে স্মৃতির বিষয় এবং কর্ণ এটাকে উপদেশ গ্রহণের উপযােগী হিসেবে গ্রহণ করে।‘ [সুরা হাক্কাহ, আয়াত : ১২]
অবশ্যই এটা একটা উপদেশবাণী। এখানে অনেক উপদেশ রয়েছে, আমি এখন আপনাদের সামনে সেই ঘটনাটি বর্ণনা করবাে।
আমাদের নবি মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদের নিকট নুহ আ.-এর ঘটনা উল্লেখ করেন, অতঃপর তিনি এক নারীর ঘটনা বলেন, যে নুহ আ.-এর সম্প্রদায় থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাে আর তুফান তখন ক্রমশ বাড়ছিল। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তখন আমি খুলে দিলাম আকাশের দ্বার প্রবল বারিবর্ষণের মাধ্যমে। এবং ভূমি থেকে প্রবাহিত করলাম প্রস্রবণ। অতঃপর সব পানি মিলিত হল এক পরিকল্পিত কাজে।‘ [সুরা কামার, আয়াত : ১১-১২]
অর্থাৎ আসমান বিরামহীনভাবে মুষল ধারে বৃষ্টি বর্ষণ করতে ছিলাে, মরুভূমি পাহাড়-পর্বত সব জায়গায় বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছিলাে। এবং ভূমি ফেটে ঝর্ণার মাধ্যমে পানি বেরুচ্ছিলাে। সব পানি মিলিত হল এক পরিকল্পিত কাজে।
যখন তুফান শুরু হল, এক মহিলা নিজ সন্তানকে নিয়ে দৌড়াচ্ছিল আর দেখতে পেয়ে সন্তানকে নিয়ে পাহাড়ে আরােহণ করল। এদিকে পানি বাড়তে বাড়তে একসময় পর্বতচূড়ায় মহিলা পর্যন্ত পৌছে যায়, তারপর শিশুটির মাথা পর্যন্ত পানি চলে আসে, তখন মহিলাটি বাচ্চাকে কোলে নেয়। অতঃপর পানি যখন মহিলাটির বুক পর্যন্ত পৌঁছে তখন সে ছেলেকে মাথার উপরে নেয়, অতঃপর পানি যখন মাথা পর্যন্ত পৌছে তখন সে বাচ্চাকে দুই হাতের উপর রেখে উচা করে ধরে রাখে এবং পানি বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে মহিলা ও ছেলেকে ডুবিয়ে দেয়। এরপর নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা যদি নুহ আ.-এর সম্প্রদায়ের কারাে উপর দয়া করতেন, কাউকে রক্ষা করতেন, তাহলে তিনি এই মহিলা ও তার সন্তানকে রক্ষা করতেন; কিন্তু আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘তারা আমার সকল নিদর্শনের প্রতি মিথ্যারােপ করেছিলাে। সুতরাং আমি পরাভূতকারী, পরাক্রমশালীর মতাে তাদেরকে পাকড়াও করেছিলাম।‘ [সুরা কামার, আয়াত : ৪২]
হে ভাই! আমরা জানি আল্লাহ তাআলা দয়ালু, তিনি আমাদের মাবাবার চেয়েও আমাদের প্রতি দয়াশীল; কিন্তু এই বুঝ যেনাে আমাদেরকে তার নাফরমানির দিকে নিয়ে না যায়। একজন সালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকবে আর বলবে, আল্লাহ তাআলা দয়ালু, তিনি আমাদের মা-বাবার চেয়েও আমার প্রতি দয়াশীল!! একজন ঘুষ খাবে আর বলবে, আল্লাহ তাআলা দয়ালু, তিনি আমাদের মা-বাবার চেয়েও আমার প্রতি দয়াশীল!! একজন অন্যায়ভাবে মানুষের হক মেরে খাবে, তার মাল চুরি করবে, তার মাল জোর করে নিয়ে খেয়ে ফেলবে, তাঁর কাছ থেকে ধার নিবে, পরে আর তা ফেরত দিবে না আর বলবে, আল্লাহ তাআলা দয়ালু, তিনি মা-বাবার চেয়েও আমার প্রতি দয়াশীল!! অসম্ভব। হাঁ, আল্লাহ তাআলা দয়াশীল ও ক্ষমাশীল; কিন্তু তােমার জন্যে আবশ্যক হল তুমি তার নাফরমানির মাধ্যমে তার এই দয়া ও ক্ষমাশীলতাকে প্রতিহত করবে না। আর এ কারণেই উলামায়ে কেরাম বলেন, বান্দার জন্যে আবশ্যক হল যে, সে আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের আশা করবে এবং সদাসর্বদা এই ভয়ে থাকবে যে, তার মাধ্যমে যেনাে আল্লাহ তাআলার কোনাে নাফরমানি না হয়ে যায়। আর এ কারণেই নবি কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বড় গুনাহের পূর্বে ছােট গুনাহ থেকে সতর্ক করেছেন।
খায়বারের যুদ্ধ থেকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবিগণ ফিরে আসছেন, পথে এক উপত্যকায় যাত্রাবিরতি করলেন। এক বালক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে থাকতেন ও তার খেদমত করতেন, অতঃপর যাত্রাবিরতি শেষে তারা যখন সেখান থেকে রওয়ানা হওয়ার ইচ্ছা করলেন তখন বালকটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উটের পিঠে জিন (আসন) বাঁধতে ছিলাে, এমন সময় দূরে কোথাও লুকিয়ে থাকা কাফেরদের অজ্ঞাত একটি তীর এসে বালটির শরীরে বিদ্ধ হল আর তখন তার ইন্তেকাল হয়ে গেল। তখন সাহাবায়ে কেরাম তাকবির দিয়ে উঠলেন এবং বললেন, আল্লাহু আকবার! জান্নাতে তাঁকে স্বাগতম! শহিদ হিসেবে তাকে স্বাগতম! একজন বালক ছেলে বাড়ি-ঘর, পিতা-মাতা ত্যাগ করে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতরত অবস্থায় কাফেরের তীরের আঘাতে শহিদ হয়েছে!! রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন: ‘কখনই নয়! আল্লাহর শপথ সে গনিমতের মাল থেকে যে চাদর চুরি করেছে তা তার উপর জাহান্নামের আগুন জ্বালিয়ে দিবে।’
অর্থাৎ গণিমতের মাল বণ্টন করার পূর্বে সে যে চাদরটি কারাে কাছে না বলে নিয়ে নিয়েছে, কবরে তা তার উপর জাহান্নামের আগুন জ্বালিয়ে দিবে, এ কারণে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে।
অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এক লােক একটি বা দুইটি জুতা বা জুতার ফিতা নিয়ে এলাে এবং তাঁকে বলল, হে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! এই নিন, এগুলাে আমি গনিমতের মাল থেকে নিয়েছিলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন বললেন: ‘একটি জুতার ফিতাও জাহান্নামের অংশ অথবা দুইটা জুতার ফিতাও জাহান্নামের অংশ।’
এ সকল ঘটনা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ তাআলার ব্যাপক দয়া, রহমত ও মাগফিরাতের কথা; এজন্যে আলােচনা করা হয়েছে যাতে করে বান্দা তার রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে পড়ে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের উপর জুলুম-অবিচার করেছাে তােমরা আল্লাহররহমত থেকে নিরাশ হয়াে না। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা সমস্ত গুনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।‘ [সুরা যুমার: ৫৩]
নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলার রহমত ব্যাপক ও বিস্তৃত; কিন্তু আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, তিনি শাস্তিদানে প্রবল ও কঠিন। সুতরাং তাঁর রহমতের অধিক আশা আমাদের যেনাে তাঁর নাফরমানির দিকে নিয়ে না যায়। অর্থাৎ আমাদের এ দুইটা তথা- আল্লাহর রহমত ও তাঁর কঠোরতা উভয়টার মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। অর্থাৎ মানুষকে আল্লাহর রহমতের আশার বাণীও শুনাতে হবে, সাথে সাথে তাকে আল্লাহর শাস্তির ভয়ও দেখাতে হবে। যেমন এক লােক আল্লাহর নাফরমানি করতে করতে নিজের ব্যাপারে নিরাশ হয়ে গেছে, সে বলছে- আমি এতাে গুনাহ করেছি যে, আল্লাহ তাআলা আমাকে আর মাফ করবেন না। তখন তাকে আল্লাহর রহমতের কথা শুনাতে হবে, ঐ মহিলার কথা বলা হবে যার ব্যাপারে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের। বলেছিলেন, সে কি তার এই ছেলেকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করতে পারবে? ঐ বৃদ্ধের ঘটনা শুনাতে হবে যে লাঠির উপর ভর করে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসেছিল, এবং সে বলেছিলাে, আমার প্রতারণা ও পাপাচারও কি ক্ষমা করা হবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বলেছিলেন, হাঁ আপনার প্রতারণা ও পাপাচারও ক্ষমা করা হবে। সাথে সাথে আমরা যদি এমন লােক দেখি, যে এই বলে বলে আল্লাহ তাআলার নাফরমানিতে লিপ্ত হচ্ছেআল্লাহ তাআলা তাে গফুরুর রহিম। এই লােককে বনি ইসরাইলের সেই নারী ও তার শিশুর ঘটনা এবং রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খাদেম বালকের ঘটনা শুনাতে হবে।
আল্লাহ তাআলার নিকট এই প্রার্থনা করি যে, তিনি আমাদের সকলকে তাঁর রহমতের চাদরে আচ্ছাদিত করুন এবং আমাদের সকলঅপরাধ ক্ষমা করুন, এবং আমাদেরকে হকের উপর অটলঅবিচল রাখুন। আমিন!!
উৎস: আত্মবিশ্বাস, পৃষ্ঠা: ১২৮ – ১৩৯
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]