আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত: পর্ব~১

4
5044

67

লিখেছেনঃ রফীক আহমাদ । ওয়েব সম্পাদনাঃ মোঃ মাহমুদ ইবনে গাফফার

পর্ব~১  ।  পর্ব~২

ক্বিয়ামত হ’ল মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ তা‘আলার অলৌকিক শক্তির রূপায়ণ ও নিদর্শন। ক্বিয়ামতের বিভীষিকাময় পরিবেশের কথা জানার জন্য বিশ্ববাসীর চরম আগ্রহের প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তা‘আলা এর সময়কাল গোপন রেখেছেন। কোন নবী-রাসূল বা ফেরেশতারাও এর আসন্ন সময়কাল জানেন না। কিন্তু সাধারণ মানুষের বিশেষ করে উম্মতে মুহাম্মাদীর অনেকে বিষয়টি বার বার জানার আগ্রহ ব্যক্ত করলে, আল্লাহ তা‘আলা এর গোপনীয়তা সংরক্ষণের কথা বিভিন্নভাবে প্রত্যাদেশ করে পৃথিবীবাসীকে অবহিত করেন।

মহান আল্লাহ বলেন: ‘লোকেরা আপনাকে ক্বিয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলুন, এর জ্ঞান আল্লাহর কাছেই আছে। আপনি কি করে জানবেন যে, সম্ভবতঃ ক্বিয়ামত শীঘ্রই হয়ে যেতে পারে’। [আহযাব ৬৩]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন: ‘বরকতময় তিনিই, নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু যাঁর। তাঁরই কাছে আছে ক্বিয়ামতের জ্ঞান এবং তাঁরই দিকে তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’। [যুখরুফ ৮৫]

ক্বিয়ামতের গোপনীয়তা রক্ষার ঘোষণায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, আমি তা গোপন রাখতে চাই, যাতে প্রত্যেকেই তার কর্ম অনুযায়ী ফল লাভ করে। সুতরাং যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের জ্ঞান রাখে না এবং নিজ প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে যেন তোমাকে তা থেকে নিবৃত্ত না করে। নিবৃত্ত হ’লে তুমি ধ্বংস হয়ে যাবে’। [ত্ব-হা ১৫-১৬]

একই বিষয়ে অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন: ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের গোপন রহস্য আল্লাহর কাছেই রয়েছে। ক্বিয়ামতের ব্যাপারটি তো এমন, যেমন চোখের পলক অথবা তার চাইতেও নিকটবর্তী। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছুর উপর শক্তিমান’। [নাহল ৭৭]

এ বিষয়ে এরশাদ হচ্ছে: ‘আপনাকে জিজ্ঞেস করে, ক্বিয়ামত কখন অনুষ্ঠিত হবে? বলে দিন, এর খবর তো আমার পালনকর্তার কাছেই রয়েছে। তিনিই তা যথাসময়ে প্রকাশ করবেন। আসমান ও যমীনের জন্য সেটি অতি কঠিন বিষয় হবে। তোমাদের উপর আকস্মিকভাবেই তা এসে যাবে। তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, যেন আপনি তার অনুসন্ধানে লেগে আছেন। বলে দিন, এর সংবাদ শুধু আল্লাহর নিকটেই রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানে না’। [আ‘রাফ ১৮৭]

ক্বিয়ামত দিবস হবে অকল্পনীয় ও অবর্ণনীয় এক মহাদিবস। মানব সৃষ্টির নেপথ্যে যে মহারহস্য নিহিত আছে, আসন্ন ক্বিয়ামত দিবসের ঘোষণায়ও অনুরূপ আশ্চর্যজনক রহস্য লুক্কায়িত আছে। এর মধ্য দিয়ে ক্বিয়ামতের সর্বোচ্চ ও সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সমূহ অক্ষুণ্ণ রাখা হয়েছে।

সর্বশক্তিমান আল্লাহর অসীম কুদরত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পরও গভীরতর বিচার-বিশ্লেষণের অভাবে একটা বৃহৎ দল ধর্মদ্বেষী হয়ে ক্বিয়ামতে অবিশ্বাসী হয়ে পড়ে। ফলে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী উভয় দলের মধ্যে বৈপরীত্য দেখা দেয়।

সর্বজ্ঞ আল্লাহ তা‘আলা এদের প্রকৃত স্বরূপ প্রকাশ করে প্রত্যাদেশ করেন যে: ‘ক্বিয়ামত অবশ্যই আসবে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অধিকাংশ লোক বিশ্বাস স্থাপন করে না’। [মুমিন ৫৯]

মূলতঃ ক্বিয়ামতে অবিশ্বাসী হচ্ছে কাফের ও মুনাফিকদের দল। কাফেরদের ক্বিয়ামতে অবিশ্বাস সম্পর্কে মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর প্রিয় রাসূল (সা:)-কে প্রত্যাদেশ করেন: ‘কাফেররা বলে, আমাদের উপর ক্বিয়ামত আসবে না। বলুন, আমার পালনকর্তার শপথ! অবশ্যই তোমাদের নিকটে আসবে। তিনি অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে তাঁর অগোচর নয় অনুপরিমাণ কিছু, না তদপেক্ষা ক্ষুদ্র এবং না বৃহৎ, সমস্তই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে’। [সাবা ৩]

একই বিষয়ে আরো বলা হয়েছে: ‘বলুন, তোমাদের জন্য একটি দিনের ওয়াদা রয়েছে, যাকে তোমরা এক মুহূর্তও বিলম্বিত করতে পারবে না এবং ত্বরান্বিতও করতে পারবে না’। [সাবা ৩০]

কাফেররা ক্বিয়ামতকে একটা মিথ্যা প্রচারণা মনে করে। ফলে তাদের মনে নানারূপ সন্দেহ-সংশয় ও অবিশ্বাস ভর করে এবং তারা বিভিন্নভাবে একে প্রত্যাখ্যান করে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন: ‘কাফেররা সর্বদা সন্দেহ পোষণ করবে যে পর্যন্ত না তাদের কাছে আকস্মিকভাবে ক্বিয়ামত এসে পড়ে অথবা এসে পড়ে তাদের কাছে এমন দিবসের শাস্তি, যা থেকে রক্ষার উপায় নেই। রাজত্ব সেদিন আল্লাহরই, তিনিই তাদের বিচার করবেন। অতএব যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং সৎকর্ম সম্পাদন করে তারা নে‘মতপূর্ণ কাননে থাকবে এবং যারা কুফরী করে এবং আমার আয়াত সমূহকে মিথ্যা বলে তাদের জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তি রয়েছে’। [সূরাঃ হাজ্জ ৫৫-৫৭]

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ বলেন: ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের রাজত্ব আল্লাহরই। যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন মিথ্যাপন্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’। [জাছিয়া ২৭]

তিনি আরো বলেন: ‘যখন বলা হয়, আল্লাহর ওয়াদা সত্য এবং ক্বিয়ামতে কোন সন্দেহ নেই, তখন তোমরা বলে থাক আমরা জানি না ক্বিয়ামত কি? আমরা কেবল ধারণাই করি এবং এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত নই। তাদের মন্দ কর্মগুলো তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়বে এবং যে আযাব নিয়ে তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত, তা তাদেরকে গ্রাস করবে’। [জাছিয়া ৩২-৩৩]

বর্তমান বিশ্বে আধুনিক বিজ্ঞানী বা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দ্বারা পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ঘোষণা দিয়ে আসছেন এবং বিগত কয়েক দশকে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার দিন তারিখও উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা এতটুকু কার্যকর হয়নি। অতএব বুঝা যায়, এ পৃথিবীর কোন কিছুই কার্যকর হয় না আল্লাহর হুকুম ব্যতীত। অবশ্য বিজ্ঞানীদের বর্ণনায় পৃথিবীর ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে ক্বিয়ামতের ধ্বংসযজ্ঞের যৎসামান্য সাদৃশ্য রয়েছে। বিজ্ঞানীদের এই তথ্যে বর্তমান বিশ্বের জনগোষ্ঠীর জন্য শিক্ষা রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত সংঘটিত হওয়ার দিনক্ষণ গোপন রেখেছেন। তিনি একদিন তা প্রকাশ করে দেবেন, আর সঙ্গে সঙ্গে ক্বিয়ামত শুরু হয়ে যাবে।

পার্থিব জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বহু বিষয়ে মানুষের কোন জ্ঞান নেই, যেমন কে কোথায় জন্মগ্রহণ করবে ও মৃত্যুবরণ করবে, আগামী কাল কি ঘটবে, কে ধনী হবে আর কে হবে দরিদ্র, কে হবে ভাগ্যবান আর কে হতভাগ্য, কে হবে অন্ধ, পঙ্গু আর কে হবে সর্বাঙ্গ সুন্দর, আর কখন হবে প্রচন্ড ঝড় ও বৃষ্টি, ভূকম্পন ও ভূমিধ্বস ইত্যাদি, কোন মানুষের পক্ষে তা জানা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু ক্বিয়ামতের মতই এগুলো আল্লাহর জানা। তাঁর পক্ষে অসম্ভব বলতে কোন কিছুই নেই।

এ মর্মে আল্লাহ বলেন: ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই ক্বিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন স্থানে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত’। [লোকমান ৩৪]

অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন: ‘ক্বিয়ামতের জ্ঞান একমাত্র তাঁরই জানা। তাঁর অজ্ঞাতসারে বাইরে কোন ফল আবরণমুক্ত হয় না এবং কোন নারী গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব করে না। যেদিন আল্লাহ তাদেরকে ডেকে বলবেন, আমার শরীকরা কোথায়? সেদিন তারা বলবে, আমরা আপনার নিকট নিবেদন করি যে, আমরা কিছুই জানি না’। [হা-মীম সাজদাহ ৪৭]

মূলতঃ ক্বিয়ামত হবে মানবজীবনের শেষ পরীক্ষা কেন্দ্র। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব জাতিকে এ পার্থিব জগতে আল্লাহর হুকুম মান্য করে এবং শয়তান-এর প্ররোচনা ও পরামর্শ হ’তে বেঁচে থেকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। যারা আল্লাহর হুকুম বা আদেশ-নিষেধ মেনে পরজগতে পাড়ি জমাতে পারবে, ক্বিয়ামত হবে তাদের জন্য আশীর্বাদ বা অভয় কেন্দ্র।  পক্ষান্তরে যারা আল্লাহকে ভুলে গিয়ে শয়তানের মিথ্যা ধোঁকায় পৃথিবীতে নানা অনাচার ও অবিচার করে মৃত্যুবরণ করবে, ক্বিয়ামত তাদের জন্য অভিশাপ, দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের কেন্দ্রে পরিণত হবে।

নির্ধারিত সময় উপস্থিত হ’লেই ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। তখন কেউ কোন কাজ করার বা কথা বলার সুযোগ পাবে না। ক্বিয়ামতের পূর্বাবস্থার একটি হাদীছ আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করা হ’ল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ক্বিয়ামত কায়েম হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না দু’টি বৃহৎ দল পরস্পর তুমুল যুদ্ধে লিপ্ত হবে। অথচ তাদের উভয় দলেরই মূল দাবী হবে এক ও অভিন্ন। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রায় ত্রিশজন মিথ্যাবাদী দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে, তাদের প্রত্যেকেই নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবী করবে। আর যতক্ষণ পর্যন্ত না ধর্মীয় ইলম উঠিয়ে নেয়া হবে। ভূমিকম্পের সংখ্যা বেড়ে যাবে। সময়ের পরিধি সংকীর্ণ হয়ে আসবে। (অর্থাৎ সময় দ্রুত অতিবাহিত হয়ে যাবে)। ফিতনা-ফাসাদ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। খুন-খারাবী, হত্যাকান্ড ও মারামারি-হানাহানি অত্যধিক বৃদ্ধি পাবে। এমনকি তোমাদের মধ্যে ধন-সম্পদের এমন প্রাচুর্য দেখা দেবে যে, সম্পদশালী ব্যক্তি, ধন-সম্পদের মালিক (তার ছাদাক্বা প্রদান করার জন্য) চিন্তিত ও পেরেশান হয়ে পড়বে এজন্য যে, কে তার ছাদাক্বা গ্রহণ করবে? এমনকি যার নিকটই সে মাল উপস্থাপন করা হবে, সে বলে উঠবে আমার এ মালের কোন প্রয়োজন নেই। আর যতক্ষণ না জনগণ সুউচ্চ ও কারুকার্যখচিত ইমারত নির্মাণ কাজে পরস্পর প্রতিযোগিতা করবে। যতক্ষণ না কোন ব্যক্তি কোন কবরের নিকট দিয়ে গমন কালে (পরিতাপ করে বলবে) হায়! আমি যদি তার স্থানে হ’তাম! আর যতক্ষণ না পশ্চিম দিক হ’তে সূর্য উদিত হবে। অতঃপর সূর্য (পশ্চিম দিক হ’তে) উদিত হ’লে জনগণ তা প্রত্যক্ষ করে সকলেই (আল্লাহর প্রতি) ঈমান আনয়ন করবে।কিন্তু ‘এখনকার ঈমান কোন লোকেরই উপকারে আসবে না। যে ব্যক্তি ইতিপূর্বে ঈমান আনয়ন করেনি কিংবা ঈমানদার অবস্থায় কোন সৎ ও ন্যায় কাজ করেনি’। [আন‘আম ১৫৮]

আর ক্বিয়ামত এমন পরিস্থিতি ও এমন অবস্থায় কায়েম হবে যে, দু’ব্যক্তি (ক্রয়-বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ক্রেতাদের সম্মুখে) কাপড় ছড়িয়ে ও খুলে বসবে। কিন্তু সে কাপড় ক্রয়-বিক্রয় কিংবা ছড়ান কাপড়টা গুটিয়ে নেয়া বা ভাঁজ করারও সুযোগ পাবে না। আর ক্বিয়ামত এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে অবশ্যই কায়েম হবে যে, এক ব্যক্তি উট দোহন করে নিয়ে আসবে, কিন্তু সে তা পান করারও সুযোগ পাবে না। ক্বিয়ামত অবশ্যই কায়েম হবে এমতাবস্থায় যে, এক ব্যক্তি তার পশুর জন্য চৌবাচ্চা বা জলাধার মেরামত বা নির্মাণ করতে থাকবে। কিন্তু তাতে সে পানি পান করাবার সুযোগ পাবে না। আর ক্বিয়ামত এমন পরিস্থিতি ও পরিবেশে অবশ্যই কায়েম হবে যে, এক ব্যক্তি খাদ্যের লোকমা বা গ্রাস তার মুখ পর্যন্ত উত্তোলন করবে কিন্তু সে তা খাওয়া ও গলধঃকরণ করার সুযোগ পাবে না। [বুখারী]

ক্বিয়ামতের ভয়াবহতা সম্পর্কে নিম্নে কয়েকটি আয়াত পেশ করা হ’ল। মহান আল্লাহ বলেন: ‘হে লোক সকল! তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। নিশ্চয়ই  ক্বিয়ামতের প্রকম্পন একটি ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সেদিন তোমরা তা প্রত্যক্ষ করবে সেদিন প্রত্যেক স্তন্যদাত্রী তার দুধের শিশুকে বিস্মৃত হবে এবং প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করবে এবং মানুষকে তুমি দেখবে মাতাল। অথচ তারা মাতাল নয়, বস্ত্ততঃ আল্লাহর আযাব  অত্যন্ত কঠিন’। [হাজ্জ ১-২]

মহান আল্লাহ বলেন: ‘যখন শিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে একটি মাত্র ফুৎকার এবং পৃথিবী ও পর্বতমালা উত্তোলিত হবে এবং এক ধাক্কায় তারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে, সেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। সেদিন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়বে এবং ফেরেশতাগণ আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আটজন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের ঊর্ধ্বে বহন করবে’।   [হাক্বকাহ ১৩-১৭]

অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন: ‘অতঃপর যখন সিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে, সেদিন তাদের পারস্পরিক আত্মীয়তার বন্ধন থাকবে না এবং একে অপরকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে না। যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই হবে সফলকাম এবং যাদের পাল্লা হাল্কা হবে তারাই নিজেদের ক্ষতিসাধন করেছে, তারা জাহান্নামেই চিরকাল বসবাস করবে’। [মুমিনূন ১০১-১০৩]

ক্বিয়ামত দিবসের প্রথম নিদর্শনই হবে সিংগায় ফুৎকারের বিকট আওয়াজ। সিংগায় এই ফুৎকারের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর সকল প্রাণী মৃত্যুবরণ করবে। পাহাড়-পর্বত ভেঙ্গে চুরমার হয়ে ধূলিকণার ন্যায় উড়ে বেড়াবে, আকাশ ও পৃথিবী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআন ও হাদীছ দ্বারা ক্বিয়ামতে শিংগায় দুইটি ফুৎকার প্রমাণিত হয়। প্রথম ফুৎকারে ধ্বংস অনিবার্য যা উপরের আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অতঃপর দ্বিতীয়বার সিংগায় ফুৎকার দেয়া হবে। ফলে অকস্মাৎ সব মৃত জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহর পানে ধাবিত হবে।

এমর্মে মহান আল্লাহর বাণী: ‘সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, ফলে আসমান ও যমীনে যারা আছে সবাই বেহুঁশ হয়ে যাবে, তবে আল্লাহ যাকে ইচ্ছা করেন। অতঃপর আবার সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তৎক্ষণাৎ তারা দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে’। [যুমার ৬৮]

একইভাবে অন্যত্র ঘোষিত হয়েছে: ‘সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে, তখনই তারা কবর থেকে তাদের পালনকর্তার দিকে ছুটে চলবে। তারা বলবে, হায় আমাদের দুর্ভাগ্য! কে আমাদেরকে নিদ্রাস্থল থেকে উত্থিত করল? রহমান আল্লাহ তো এরই ওয়াদা দিয়েছিলেন এবং রাসূলগণ সত্য বলেছিলেন’। [ইয়াসীন ৫১-৫২]

একই বিষয়ে মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘যেদিন সিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে, অতঃপর আল্লাহ যাদেরকে ইচ্ছা করবেন, তারা ব্যতীত নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলে যারা আছে, তারা সবাই ভীত-বিহবল হয়ে পড়বে এবং সকলেই তার কাছে আসবে বিনীত অবস্থায়’। [নামল ৮৭]

যারা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে তারাই ক্বিয়ামতে সফলকাম হবে। পক্ষান্তরে যারা ক্বিয়ামতকে মিথ্যা ভাববে এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহকে অবিশ্বাস করবে, তারা ক্বিয়ামতে কোপানলে পতিত হবে। এজন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সকল বান্দাকে সঠিকভাবে ক্বিয়ামতের বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহামূল্যবান আদেশ সমূহকে একাধিকবার বা বহুবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রত্যাদেশ করেছেন। তন্মধ্যে ক্বিয়ামতের ভীতিকর ও আতংকজনক আলোচনা নিঃসন্দেহে অন্যতম। ক্বিয়ামতের অচিন্তনীয় ও নিদারুণ শাস্তির প্রেক্ষাপটেই দয়াশীল আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের বহুমুখী আয়াতগুলো অবতীর্ণ করেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির সেরা বস্ত্তগুলির নামে বার বার শপথ করে প্রত্যাদেশ করতে থাকেন বান্দার হৃদয়ে ভীতি সঞ্চারের উদ্দেশ্যে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘শপথ সেই ফেরেশতাগণের, যারা ডুব দিয়ে আত্মা উৎপাটন করে। শপথ তাদের, যারা আত্মার বাঁধন খুলে দেয় মৃদুভাবে। শপথ তাদের, যারা সন্তরণ করে দ্রুতগতিতে, শপথ তাদের যারা দ্রুতগতিতে অগ্রসর হয় এবং শপথ তাদের, যারা সকল কর্মনির্বাহ করে। যেদিন প্রকম্পিত করবে প্রকম্পিতকারী, অতঃপর পশ্চাতে আসবে পশ্চাদগামী, সেদিন অনেক হৃদয় ভীত-বিহবল হবে। তাদের দৃষ্টি নত হবে’। [নাযি‘আত ১-৯]

ক্বিয়ামতের অপরিসীম দৃঢ়তা ব্যক্ত করে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন: ‘কল্যাণের জন্য প্রেরিত বায়ুর শপথ, সজোরে প্রবাহিত ঝটিকার শপথ, মেঘ বিস্তৃতকারী বায়ুর শপথ, মেঘপুঞ্জ বিতরণকারী বায়ুর শপথ এবং অহী নিয়ে অবতরণকারী ফেরেশতাগণের শপথ, ওযর-আপত্তির অবকাশ না রাখার জন্য অথবা সতর্ক করার জন্য; নিশ্চয়ই তোমাদেরকে প্রদত্ত ওয়াদা বাস্তবায়িত হবে। অতঃপর যখন  নক্ষত্রসমূহ নির্বাপিত হবে, যখন আকাশ ছিদ্রযুক্ত হবে, যখন পর্বতমালাকে উড়িয়ে দেয়া হবে এবং যখন রাসূলগণের একত্রিত হওয়ার সময় নিরূপিত হবে, এসব বিষয় কোন দিবসের জন্য স্থগিত রাখা হয়েছে? বিচার দিবসের (ক্বিয়ামতের) জন্য’। [মুরসালাত ১-১৩]

মহান আল্লাহ আরও বলেন: ‘আমি শপথ করি ক্বিয়ামত দিবসের, আরও শপথ করি সেই মনের, যে নিজেকে ধিক্কার দেয়। মানুষ কি মনে করে যে, আমি তার অস্থিসমূহ একত্রিত করব না? পরন্তু আমি তার অঙ্গুলিগুলো পর্যন্ত সঠিকভাবে সন্নিবেশিত করতে সক্ষম। বরং মানুষ তার ভবিষ্যৎ জীবনেও পাপাচার করতে চায়। সে প্রশ্ন করে, ক্বিয়ামত দিবস কবে? যখন দৃষ্টি চমকে যাবে, চন্দ্র জ্যোতিহীন হয়ে যাবে এবং সূর্য ও চন্দ্রকে একত্রিত করা হবে। সেদিন মানুষ বলবে, পলায়নের জায়গা কোথায়? না কোথাও আশ্রয়স্থল নেই, আপনার পালনকর্তার কাছেই সেদিন ঠাঁই হবে। সেদিন মানুষকে অবহিত করা হবে, সে যা সামনে প্রেরণ করেছে ও পশ্চাতে ছেড়ে দিয়েছে’। [ক্বিয়ামাহ ১-১৩]

অতঃপর মানুষকে বিচারের সম্মুখীন হ’তে হবে এবং সে জানতে পারবে নিজের সৎ ও অসৎ কর্মের হিসাব। অপরাধীরা তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়বে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আমি ক্বিয়ামতের দিন ন্যায়-বিচারের মানদন্ড স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি সামান্যতম যুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্য আমিই যথেষ্ট’। [আম্বিয়া ৪৭]

অন্য এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন: ‘যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা হতাশ হয়ে যাবে’। [রূম ১২]

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে: ‘যেদিন ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন অপরাধীরা কসম খেয়ে বলবে যে, এক মুহূর্তেরও বেশী অবস্থান করিনি। এমনিভাবে তারা সত্য বিমুখ হ’ত’। [রূম ৫৫]

পর্ব~১  ।  পর্ব~২

[চলবে]


'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে
আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্‌র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]

দ্বীনী খিদমায় অংশ নিন

4 COMMENTS

আপনার মন্তব্য লিখুন