লেখক: ড. খালিদ আবু শাদি | অনুবাদক: হাসান মাসরুর
১. আজকের আলোচ্য বিষয়ের ফায়দা
- ঐক্য হলো শক্তি।
নবিজি (সা:) বলেন: ‘আর তারা অন্য সকলের বিরুদ্ধে এক হাতের মতো।‘ [সুনানু আবি দাউদ : ২৭৫১, সুনানু ইবনি মাজাহ : ২৬৮৩]
- এর ফলে আমাদের শত্রুদের হৃদয়ে ভয় সৃষ্টি হয় ৷
- ভ্রাতৃত্ব, একতা ও পরস্পরের সম্পর্কবোধ জাগ্রত হয় ৷
- আমাদের দুর্বল ভাইদের সহযোগিতা করা যায় এবং তাদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া যায় ৷
২. কুরআনের আলো
আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয় তোমাদের এ জাতি তো একই জাতি। আর আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব, আমার ইবাদত করো।” [সুরা আল-আম্বিয়া, ২১ : ৯২]
উসতাজ সাইয়িদ কুতুব (রা:) বলেন: ‘আল্লাহ তাআলা যখন মুসলিমদেরকে তাদের ধর্মের পরিচয় দিতে চেয়েছেন, যে ধর্ম তাদেরকে জমানার পরিবর্তন সত্ত্বেও এক করে রেখেছে, তখন তাদেরকে প্রত্যেক জমানায় রাসুলের অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। আর তিনি তাদেরকে এই ধর্মের সর্বশেষ প্রজন্মের কথা তুলে ধরে বলেছেন: “নিশ্চয় তোমাদের এ জাতি তো একই জাতি। আর আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব, আমার ইবাদত করো।” [সুরা আল-আম্বিয়া, ২১ : ৯২]
তিনি আরবদেরকে এ কথা বলেননি যে, তোমাদের ধর্ম হলো আরবের ধর্ম। ইহুদিদেরকেও বলেননি যে, তোমাদের উম্মত হলো বনি ইসরাইল বা হিব্রুগণ। সালমান আল-ফারসিকে বলেননি যে, তোমার জাতি হলো পারস্য জাতি। সুহাইব আর-রুমিকে বলেননি, তোমার জাতি হলো রোমান জাতি ৷ বিলাল আল-হাবশিকে বলেননি যে, তোমার জাতি হলো হাবশার মানুষ। বরং আরব, পারস্য, রোম ও হাবশার সকল মুসলিমকে বলেছেন যে, তোমাদের জাতি হলো মুসলিমদের জাতি, যারা মুসা ও হারুন এ-এর যুগে তাঁদের ওপর ইমান এনেছে। তারা ইমান এনেছে ইবরাহিম, লুত, নুহ, দাউদ, সুলাইমান, ইসমাইল, ইদরিস, যুল-কিফল, জুন-নুন, জাকারিয়া, ইয়াহইয়া এবং মারইয়ামের ওপর। আল্লাহর সংজ্ঞামতে এরাই হলো মুসলিম জাতি।
সুতরাং যে আল্লাহর পথ বাদ দিয়ে ভিন্ন পথ গ্রহণ করতে চায়, সে চাইলে তা গ্রহণ করতে পারে। তবে সে যেন এ কথা বলে নেয় যে, সে মুসলিম নয়! আরে, আমরা কি সেসব লোক নই, যারা আল্লাহর জন্য ইসলাম গ্রহণ করেছি। সুতরাং আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে যে জাতির পরিচয় দিয়েছেন, আমরা শুধু সে জাতির পরিচয়ই গ্রহণ করব। আল্লাহ তাআলা সত্য বর্ণনা করেন। আর তিনি হলেন সর্বোত্তম ফয়সালাকারী।
৩. রাসুল (সা:) আমাদের আদর্শ
- জনৈক মুসলিম মহিলা বনু কাইনুকার এক ইহুদি স্বর্ণকারের দোকানে স্বর্ণ কিনতে গেলেন। সেখানে তিনি বসলেন। তার পাশে তখন কিছু ইহুদি ছিল। তারা তাকে নিকাব খুলতে বলল। তারা তার পর্দা নিয়ে বাজে মন্তব্য করল। তিনি তার নিকাব খুলতে অস্বীকার করলেন। তাদের একজন এই মহিলার অমনোযোগিতার সুযোগ নিয়ে তার কাপড়ের এক প্রান্ত উড়নার এক প্রান্তের সাথে বেঁধে দিল। যখন সে মহিলা দাঁড়ালেন, তখন তার কাপড় উঠে গেল। অবস্থা এমনই অবমাননাকর হওয়ায় তিনি চিৎকার করে উঠলেন।
জনৈক মুসলিম তার চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পেয়ে (তার দিকে) দৌড়ে গেলেন এবং সেই ইহুদিকে আঘাত করে হত্যা করে দিলেন। তখন ইহুদিরা সকলে উঠে দাঁড়াল এবং সেই মুসলিমকেও হত্যা করে দিল। ফলে রাসুল (সা:) তাদের সাথে যুদ্ধ করলেন, এমনকি তাদেরকে মদিনা থেকে বের করে দিলেন। তিনি এই যুদ্ধ করেছিলেন একজন মুসলিম নারীর সম্ভ্রমহানির প্রতিশোধ গ্রহণ ও একজন পুরুষ মুসলিমের রক্তের বদলা নেওয়ার জন্য।
- রাসুল (সা:) হারিস বিন উমাইর আল-আসাদিকে দূত হিসেবে বসরার শাসকের কাছে প্রেরণ করলেন। কিন্তু শুরাহবিল বিন আমর আল-গাসসানি তাকে হত্যা করে ফেলল। রাসুল (সা:) তার দুঃসাহসিকতার বিরুদ্ধে তিনজন আমিরের [জাইদ, জাফর এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রা:)] নেতৃত্বে বিশাল একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করলেন। যেন এরা মুতার যুদ্ধে রোমান ও গাস্সানিদের দুই লক্ষ সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করেন। আর এসবই হয়েছে একজন মুসলিমের মর্যাদা রক্ষার জন্য।
৪. অমূল্য বাণী
- ইবরাহিম বিন আদহাম (রা:) বলেন, ‘মুমিনের চরিত্র হলো অন্য মুমিনকে সান্ত্বনা প্রদান করা।’
- ইবনুল কাইয়িম (রা:) বলেন, ‘সান্ত্বনা প্রদান কয়েক ধরনের হতে পারে। সম্পদের ব্যাপারে সান্ত্বনা প্রদান, মর্যাদার ব্যাপারে সান্ত্বনা প্রদান, দেহের ব্যাপারে সান্ত্বনা প্রদান এবং খিদমতের ব্যাপারে সান্ত্বনা প্রদান, নসিহত ও দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে সান্ত্বনা প্রদান এবং তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। তাদের ব্যথা উপলব্ধি করে সান্ত্বনা দেওয়া। আর ইমানের স্তর অনুযায়ী এই সান্ত্বনার পর্যায় নির্ধারিত হবে। যখন ইমান দুর্বল হবে, তখন সান্ত্বনা প্রদানও দুর্বল হবে। আর যখন ইমান শক্তিশালী হবে, তখন সান্ত্বনা প্ৰদান ও শক্তিশালী হবে। আর রাসুল (সা:) নিজের সাথিদের সান্ত্বনা প্রদানে সর্বোত্তম ব্যক্তি ছিলেন।
সুতরাং সান্ত্বনা প্রদানে তাঁর সাথিরা তাঁর অনুসরণের ভিত্তিতে যোগ্যতাসম্পন্ন হবে। বিশর আল-হাফি (রা:)-এর কাছে লোকজন গিয়ে দেখল, তিনি প্রচণ্ড শীতের দিন খালি শরীরে আছেন। শীতের প্রচণ্ডতায় তিনি কাঁপছিলেন। তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হে আবু নসর, আপনার কী হয়েছে?’ তিনি বললেন, ‘আমি ফকিরদের কথা ও তাদের শীতের কথা স্মরণ করছি । আর আমার কাছে এমন কোনো জিনিস নেই, যা দিয়ে আমি তাদেরকে সান্ত্বনা দেবো। তাই আমি তাদের শীতে শরিক হয়ে তাদেরকে সান্ত্বনা দানের ইচ্ছা করলাম!!’
- নবিজি (সা:) বলেন: ‘পরস্পর ভালোবাসা, দয়া ও অনুগ্রহে মুমিনের দৃষ্টান্ত হলো একই দেহের মতো। যখন তার এক অঙ্গ অসুস্থ হয়, তখন তার বাকি সব অঙ্গ বিনিদ্র ও জ্বরের শিকার হয়।‘ [সহিহুল বুখারি: ৬০১১, সহিহু মুসলিম: ২৫৮৬]
৫. কিছু চমৎকার কাহিনি
এই সম্মান আবার ফিরে আসবে
- আল-হাজিব আল-মানসুর মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ বিন আবু আমির আল- মাআরিফি (রা:) (৩২৮ হি./ ৯৪০ খ্রি. ৩৯২ হি./৯৯৫ খ্রি.) উত্তর স্পেনের অনেক বড় বড় খ্রিষ্টান রাজ্যকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। নিজের ক্ষমতার সামনে তাদেরকে নত করেছিলেন। তার সিস্টেমে তাদেরকে শাসন করতে বাধ্য করেছেন এবং জিজিয়া প্রদানেও বাধ্য করেছেন। তারা জিজিয়া আদায় করেছিল অবনত মস্তকে লাঞ্ছিত অবস্থায়। কর্ডোভার ভার্সিটি তৈরির জন্য তাদের মাধ্যমে রোমের শেষ প্রান্ত থেকে মাটি আনতে বাধ্য করেছিলেন । আর এটি হয়েছিল তার পঞ্চাশের অধিক যুদ্ধের প্রতিটি যুদ্ধ থেকে ফায়দা গ্রহণের মাধ্যমে।
৬. রমাদানে এক উম্মাহ
আমরা রমাদানে এক সময়ে একই সাথে রোজা রাখি এবং একই সময়ে ইফতার করি। আমরা একই কিবলার দিকে ফিরে সালাত আদায় করি। একই দুআ, একই রুহ, একই অনুভূতি ও উপলব্ধি এবং একই আশার সাথে দুআ করি। যেন রমাদান এমন এক কারখানা, যা উম্মাহর মাঝে একতার গুণাবলি তৈরি করে এবং আমাদের উপলব্ধিগুলোকে একত্রিত করে। আমাদের শত্রুরা কৃত্রিম যে সীমানা এঁকে দিয়েছে, তা ভেঙে ফেলে।
(কিন্তু আজ কী হচ্ছে!) আমরা কি এখন তারাবিহের রাকআত-সংখ্যা নিয়ে কথার সংঘাতে জড়িয়ে থাকব এবং ইমামদের সুর আর সুন্দর দুআ নিয়ে তর্ক- বিতর্ক করব?! কেমন যেন আমাদের ইবাদতে এ ছাড়া অন্য কোনো দিক নেই! আফসোস, আমরা আজ ভুলে গেছি ভ্রাতৃত্বের মজবুত বন্ধন! ভুলি বসেছি তার শক্তিশালী সম্পর্ক এবং হারিয়ে যাওয়া এই ফরজ বিধান!
৭. উম্মাহর একতার সূর্য ডুবে গেছে
- গাজা, ইরাক ও বসনিয়ার ক্ষতগুলোর ব্যাপারে আমাদের অনুভূতি আজ শীতল হয়ে গেছে।
- সামান্য বিষয় নিয়ে মুসলিমদের পরস্পরের মাঝে শত্রুতা চলছে। যেমন: ফুটবল ইত্যাদির মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে, যেমনটি ঘটেছে মিশর ও আলজেরিয়ার মাঝে। মিশর ও ফিলিস্তিনিদের মাঝেও রয়েছে শত্রুতা। সৌদি ও ইয়ামানের মাঝে শত্রুতা চলছে। কারণ, এখন আমরা আমাদের (আসল) শত্রুদের সাথে শান্তিচুক্তি করি, তাদের সাথে কথা বলি নরম ভাষায় । অবস্থা তো এমন নাজুক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, বর্তমানে শত্রুকে বন্ধু ও বন্ধুকে শত্রু বানানো হচ্ছে।
৮. দুআ
- হে আল্লাহ, আমাদের শক্তিকে আমাদের বিরুদ্ধে লাগাবেন না এবং আমাদের শক্তি আমাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে কাজে লাগান ৷
- হে আল্লাহ, সকল মুসলিম দেশে আপনার দুর্বল বান্দাদের সাহায্য করুন। তারা যে করুণ অবস্থায় আছে, তা থেকে তাদেরকে নিষ্কৃতি দান করুন।
- হে আল্লাহ, অবরুদ্ধ মুসলিমদের অবরোধ থেকে মুক্তি দান করুন, দুশ্চিন্তাগ্রস্তদের দুশ্চিন্তা দূর করে দিন এবং বন্দীদের বন্দিত্ব দূর করে দিন। হে রব্বুল আলামিন, তাদের যারা গুমের শিকার হয়েছে, আপনিই তাদের উত্তম অভিভাবক হয়ে যান।
৯. স্বার্থপর হবেন না
- কথাগুলো আপনার মসজিদের মুসল্লি ও আপনার সহপাঠী-সহকর্মীদের মাঝে আলোচনা করুন।
- এই বইটি নিজে পাঠ করে অন্যদেরকেও পড়তে দিন; যেন তারা এর থেকে উপকৃত হতে পারে।
- মসজিদের ইমামকেও বইটি হাদিয়া দিতে পারেন; যেন তিনি জুমআর খুতবা বা তারাবিহ-পরবর্তী আলোচনায় এর থেকে ফায়দা গ্রহণ করতে পারেন।
১০. যথেষ্ট কথা হয়েছে, এখন আমল দেখার বিষয়
- আমরা মুসলিমদের খবর জানব এবং তাদের জন্য দুআ করব।
- আর্থিকভাবে সহযোগিতাসহ তাদের সাথে মিলে জিহাদ করব। শুধু দান করেই ক্ষান্ত থাকব না। এমনি দান করা তো নফল বিষয়; কিন্তু জিহাদ করা ফরজ।
- মুসলিমদের বিষয়গুলো নিয়ে অন্যদের সাথে আলোচনা করব। আর এখানে পরস্পরের মাঝে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে আরও সুদৃঢ় করা এবং ছিন্ন হওয়া সম্পর্ককে মজবুত করার নিয়ত করব।
- দরিদ্র লোকদের খুঁজে বের করব এবং অভাবী লোকদের খবর নেব। যেই কোনো প্রয়োজন নিয়ে আমার কাছে আসবে, তার সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আমি সচেষ্ট হব।
- বংশীয় সম্পর্কের চেয়ে দ্বীনি সম্পর্ক আরও শ্রেষ্ঠ । দেশ ও রক্তের সম্পর্কের চেয়ে দ্বীনি সম্পর্ক বেশি মজবুত।
উৎস: রমাদান-আত্মশুদ্ধির বিপ্লব, পৃষ্ঠা: ১৫১ – ১৫৮
'আপনিও হোন ইসলামের প্রচারক'
প্রবন্ধের লেখা অপরিবর্তন রেখে এবং উৎস উল্লেখ্য করে আপনি Facebook, Whatsapp, Telegram, ব্লগ, আপনার বন্ধুদের Email Address সহ অন্য Social Networking ওয়েবসাইটে শেয়ার করতে পারেন, মানবতার মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিন। ইসলামি দা’ওয়াহ্র ৮০ টিরও বেশী উপায়! বিস্তারিত জানতে এইখানে ক্লিক করুন "কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা" [সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪]